নিরাপত্তা চাইলে নিলয়কে ‘দেশ ছাড়তে’ বলেছিল পুলিশ

ঢাকার গোড়ানে নিজের বাসায় জঙ্গি কায়দায় খুন হওয়া ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় তাকে অনুসরণ করার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন প্রায় তিন মাস আগে, যা তিনি ফেইসবুকে একটি পোস্টেও লিখে গেছেন।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2015, 11:58 AM
Updated : 7 August 2015, 04:49 PM

গত ১৫ মে ওই পোস্টে নিলয় লিখেছেন, তিনি জিডি করলে চাইলেও থানা তা নেয়নি, বরং তাকে যত দ্রুত সম্ভব ‘দেশ ছেড়ে’ চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

বছর দুই আগে মৌলবাদী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফারাবী শফিউর রহমানের একটি লেখায়ও নিলয়ের নাম এসেছিল। ফেইসবুকে উগ্রপন্থি বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার এবং লেখক-সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দিয়ে আলোচিত ফারাবী গত মার্চে লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন।

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নিলয় ‘ইস্টিশন’ নামের একটি ব্লগে লিখতেন ‘নিলয় নীল’ নামে। গত কিছুদিন ধরে হুমকি পেয়ে আসছিলেন বলে ফেইসবুক থেকে নিজের সব ছবি সরিয়ে ফেলে তিনি ঠিকানার জায়গায় বাংলাদেশের বদলে ভারতের কলকাতার কথা লিখেছিলেন বলে ঘনিষ্টরা জানান।  

শুক্রবার জুমার নামাজের পরপর চার থেকে পাঁচজন লোক বাসা দেখার কথা বলে গোড়ান টেম্পোস্ট্যান্ডের কাছে নিলয়ের বাসায় ঢোকে এবং তাকে কুপিয়ে, জবাই করে চলে যায় বলে পুলিশের ভাষ্য।

খুন হওয়ার ৮৩ দিন আগে ফেইসবুকে নিলয় লেখেন, “আমাকে দুজন মানুষ অনুসরণ করেছে গত পরশু। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান শেষে আমার গন্তব্যে আসার পথে এই অনুসরণটা করা হয়।”

ঘটনার বর্ণনায় তিনি লেখেন, “প্রথমে পাবলিক বাসে চড়ে একটা নির্ধারিত স্থানে আসলে তারাও আমার সাথে একই বাসে আসে। এরপর আমি লেগুনায় উঠে আমার গন্তব্যস্থলে যাওয়া শুরু করলে তাদের মধ্যে একজন আমার সাথে লেগুনায় উঠে। লেগুনায় বসে আমার মনে পড়ে বাসে তো এই ব্যক্তিই ছিলো কিন্তু তারা তো দুইজন ছিল। মনে মনে ভাবি হতেই পারে, একজনের গন্তব্য অন্যদিকে তাই সে চলে গেছে।

“এ পর্যন্ত ব্যপার স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে লেগুনায় বসে সেই যুবক ক্রমাগত মোবাইলে টেক্সট করছিল যা দেখে আমার সন্দেহ হয়। আমি আমার নির্ধারিত গন্তব্যস্থলের আগেই নেমে গেলে আমার সাথে সেই তরুণও নেমে পড়ে। আমি বেশ ভয় পেয়ে সেখানের একটি অপরিচিত গলিতে ঢুকে যাই। পরে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঐ তরুণের সাথে বাসে থাকা আরেক তরুণ এসে যোগ দিয়েছে এবং তারা আমাকে আর অনুসরণ না করে গলির মুখেই দাড়িয়ে আছে।”

তখনই নিলয় নিশ্চিত হন, যে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে। পরে গলির আরও ভেতরে গিয়ে তিনি একটি রিকশায় উঠে হুড ফেলে দেন এবং পরে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ‘নিরাপদ’ স্থানে সরে যান।

কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে জিডি করতে গিয়ে বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয় এই ব্লগারকে।

তিনি লিখেছেন, “…তারা জিডি নিলো না, তারা বললো আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।”

নিলয় ওই পোস্টে এক জায়গায় লিখেছিলেন, কারও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে জিডি নিলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হয় বলে কেউ জিডি নিতে চায় না; একজন পুলিশ কর্মকর্তাই ‘ব্যক্তিগতভাবে’ তাকে এ বিষয়টি বলেছিলেন।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, “একটি ঘটনা ঘটেছে... আমরা এখন স্পটে সেই বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত আছি। আগে তিনি কোথাও জিডি করতে গিয়েছিলেন কি না, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।”

২০১৩ সালের ২৮ অগাস্ট ফেইসবুকে অন্য একটি পোস্টে নিলয় জানান, ফারাবী শফিউর রহমানের একটি উসকানিমূলক লেখায় তার নামও এসেছে।

ফরাবীর ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়া হলেও একটি ব্লগে এখনও ফারবীর সেই লেখাটি রয়েছে।

‘আসলে এরা নাস্তিক না, এরা হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষী ও জ্ঞানপাপী’ শিরোনামে ফারাবীর ওই লেখায় বলা হয়, “দাঁড়িপাল্লা ধমাধম, সাদিয়া সুমি উজ্জা, অনন্য আজাদ, Shuvo Michael D Costa, Niloy Neel এই ফেইসবুক আইডিগুলিতো প্রতিদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে অনেক অশ্লীল Status Post করে।

“…আসলে এরা নাস্তিক না, এরা হচ্ছে ইসলামবিদ্বেষী ও জ্ঞানপাপী।… আমি ফারাবী খুব সাধারণ একটি ছেলে। আমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকলেও কারো কোন যায় আসে না বা মারা গেলেও কারো কোন যায় আসে না।

“কুলাঙ্গার নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য যদি আবার আমাকে কাশিমপুর কারাগারে যেতে হয় আমি তাতেও রাজি আছি। তাও আমি নাস্তিকদের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করবো না।”

ফেইসবুকের পাশাপাশি ব্লগে ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’ ও ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির’ বিরুদ্ধে লেখালেখি করা নিলয় বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়েও সমালোচনা করেছেন।

মৌলবাদীদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘মৌলবাদের থাবায় বন্ধ হলো রোদেলা প্রকাশনী!’ শিরোনামে তার একটি লেখা ইস্টিশন ব্লগে আসে একুশে বইমেলা চলাকালে।

অন্য একটি লেখায় বাম নেতাদের সমালোচনায় তিনি লেখেন, “বাংলাদেশে এখন ২ প্রকার বাম আছে, এক প্রকার হলো ক্ষমতাসীনের কলা ধরে সুযোগ সুবিধা নিয়ে বিপ্লব করছে। আরেক প্রকার হলো আদর্শ সমুন্নত রেখে কারও কলা না ধরে সকল কলার সমালোচনা করে কলাবিশারদ হয়ে বিপ্লব করছে।”

ইস্টিশন ব্লগে ‘শাঁখা সিঁদুর নিয়ে কিছু স্বতন্ত্র চিন্তা’, ‘ওম নমঃ খা ল্যাদায়ঃ’, বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্রঃ নারীরা হল উন্মুক্ত মলের মতো দুর্গন্ধযুক্ত’সহ বিভিন্ন শিরোনামে বেশ কিছু লেখা রয়েছে নিলয়ের।

খুন হওয়ার আগে শুক্রবার দুপুর ১টা ৮ মিনিটে সুরমা মেহজাবিন নামের একজনের ফেইসবুকের পোস্ট শেয়ার করেন নিলয়। ঠিক তার আগেই কাবুলে বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা নিয়ে বিবিসির একটি প্রতিবেদন তিনি শেয়ার করেন, যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদের সমালোচনা করা হয়।

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার ও গোলাম মুজতবা ধ্রুব।]