মাদারীপুরের বড় চরলক্ষীপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হাসিদা বেগমের স্বামী দাদন হাওলাদার (৫৮) রোববার মুক্ত হন। মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে বসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে অপহৃত হওয়ার পর বন্দি দশা ও মুক্তি পাওয়ার আদ্যোপান্ত বলেন তিনি।
দাদন জানান, গত ২৭ জুলাই রামপুরায় এক আত্নীয়ের বাসা থেকে সাভারে আরেক আত্নীয়ের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে কারওয়ানবাজার থেকে বিআরটিসির একটি বাসে চড়ে গাবতলী পৌঁছান। গাবতলীতে নেমে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে দুই যুবক নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেন। ওই গাড়িতে মোট পাঁচজন ছিলেন।
মাইক্রোবাসে উঠার কিছুক্ষণ পরই অপহরণকারীরা নাকে রুমাল চেপে ধরলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বলে জানান দাদন।
এরপর জ্ঞান ফিরলে একটি মাটির ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নিজেকে দেখতে পান দাদন হাওলাদার।
তিনি বলেন, “অধিকাংশ সময়ই আমার হাত-পা, মুখ-চোখ বাঁধা থাকত। এদিকে মুক্তিপণের টাকা চেয়ে অপহরণকারীরা আমার স্ত্রীকে ফোন দিত। সে সময় আমাকে প্রচণ্ড মারধর করত।”
দাদন অপহৃত হওয়ার পরদিন রামপুরা থানায় একটি জিডি করে তার পরিবার।
এদিকে ওই দিন পেরিয়ে রাত থেকে দাদনের মোবাইল থেকে তার স্ত্রীকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
“আমাকে দিয়ে ওরা আমার স্ত্রীকে ফোন করায়। আমি বলি, ‘আমাকে মেরে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। ওদের টাকা পাঠাও।’ এ সময় আমার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে তাদের একজন। স্ত্রীকে শোনাতে ওই সময় আমাকে ব্যাপক মারধর করে তারা।”
মুক্তিপণের টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বলে জানান দাদন।
অপহৃত অবস্থায় তাকে ভাত ও সবজি খেতে দেওয়া হলেও তিনি শুধু পানি খেয়েই কাটাতেন জানিয়ে দাদন হাওলাদার বলেন, “ওই সাতদিন ছিল জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন। বাঁইচা বাড়ি ফিরতে পারমু তাতো ভাবি নাই কোনো দিন।”
প্রথম তিন রাত তাকে ওই মাটির ঘরে হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছিল। পাহারা দেওয়ার জন্য ছিল দুই যুবক।
চতুর্থ রাতে চোখ বেঁধে প্রায় দুই ঘণ্টা কাদা মাটির পথ ধরে হাঁটিয়ে তাকে আরেকটি মাটির ঘরে নেওয়া হয় বলে জানান দাদন হাওলাদার।
এরপর তার স্ত্রীর মোবাইলে বারবার কল করে তারা টাকা চাইছিল বলে জানান তিনি।
কোথা থেকে দাদনের স্ত্রীকে ফোন করে মুক্তিপণের টাকা চাওয়া হচ্ছিল তা বের করে দেন তাদের পরিবারের পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তা।
ওই তথ্য পেয়ে নাটোরে গিয়ে অবস্থান নেন দাদনের চাচাত ভাই ফল ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন। তার সঙ্গে নাটোরের আরেক ফল ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম রবির আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। ভাইকে উদ্ধারে রবির সহযোগিতা চান তিনি।
পরে অপহরণকারীদের কথা মত একটি বিকাশ নম্বরে তিন লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন দাদনের স্ত্রী হাসিদা। শাহাদাত নাটোর থেকে সেই টাকা তুলে রবির হাতে দেন। পরে রবি, শাহাদাত ও দাদনের মামা কালাম নাটোরের বাইমেল রানীর হাট এলাকায় অপহরণকারীদের হাতে সেই টাকা তুলে দেন।
“তিন লাখ টাকা পাওয়ার পরও ওরা আমাকে ছাড়তে রাজি হয় নাই। তারা আরও দুই লাখ টাকা চাইসিল। ওদের অনেকে যদিও তিন লাখেই খুশি হইসিল। তারা বলাবলি করসিল, তিন জনে পাইব দেড় লাখ আর বাকি দেড় লাখ নিমু নয় জনে। আরও বেশি টাকা নিতে পারলে ভালো হইত,” বলেন দাদন।
অপহরণের ষষ্ঠ দিনে টাকা বুঝে পাওয়ার পর অপহরণকারীরা গভীর রাতে তাকে আবারও চোখ বেঁধে প্রায় দুই ঘণ্টা কাদা মাটির পথ হাঁটিয়ে নেয়।
“এরপর আমার হাতে ১০০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে, ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার হাঁটলে একটা বাসস্ট্যান্ড পাইবি। ওখান থেইকা বাসে উইঠা বাড়ি ফিরা যাইস।”
কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে রোববার ভোর রাতে একটা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছান বলে জানান দাদন।
“সেখান থেকে লোকাল বাসে চড়ে ৬০ টাকা ভাড়ায় সিরাজগঞ্জ গোলচত্বরে আসি। পরে আমার কাসে টাকা নাই বইলা বাসায় ফোন দেই। সেখানে বিকাশে আমাকে কিছু টাকা পাঠাইলে আমি সাভারে পরিবারের কাসে ফিরা যাই।”
অপহরণের জন্য কাউকে সন্দেহ করছেন কি না জানতে চাইলে দাদন বলেন, “আমাকে অপরহণের দিন মাইক্রোবাসে যে পাঁচজন ছিল তাদের একজনের নাম মোশাররফ। ওর বাড়ি নাটোর। ছয় মাস আগে আমাদের এলাকার একজনের বাসায় বেড়াতে আসছিল।
“এলাকার দোকানে একসঙ্গে চা খাইসিলাম। বলসিলাম আমার তিন পোলা দেশের বাইরে থাকে। হয়তো ওই লোভেই আমাকে অপহরণ কইরা টাকা আদায় করতে চাইসিল।”
এছাড়া প্রথম তিন রাত তার পাহারায় যে দুই যুবককে রাখা হয়েছিল তাদের কথাও নাটোর অঞ্চলের ভাষা মনে হয়েছিল বলে জানান দাদন।
এই অপহরণের ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে থাকা রামপুরা থানার এসআই জসিম উদ্দিন মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৩/৪ দিন আগে তার পরিবারের সঙ্গে কথা হলে তারা জানিয়েছিল, দাদনকে তারা খুঁজে পাননি। দাদনের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।”
আধা ঘণ্টা পরে ফোন দিয়ে দুদিন আগে দাদনের বাসায় ফিরে আসার কথা জানান তিনি।
তবে তিনি কীভাবে পরিবারের কাছে ফিরে এলেন জানতে চাইলে এসআই বলেন, “পরিবার শুধু বলেছে ফিরে এসেছে। কীভাবে ফিরে এসেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেনি।”