নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়রা বলছেন, সোহেল নামে ওই যুবককে তারা কখনও সিগারেট কিংবা বিড়ি খেতেও দেখেননি, মাদক তো দূরের কথা।
সোহেলের পরিবারের দাবি, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি প্রত্যাশা করে তার চাচাত ভাই আবুল কালাম আজাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে তাকে মাদক মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
তবে র্যাবের দাবি, ইয়াবাসহ আটকের পর সোহেলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আরও ট্যাবলেট পাওয়ার পরই এই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাদিপুর ইউনিয়নের পঞ্চমীঘাটের বাড়ি থেকে রোববার রাতে আটকের পর সোহেলের কাছে ৩৭০টি ইয়াবা পাওয়ার দাবি করে তাকে আসামি করে সোনারগাঁও থানায় মামলা করেন র্যাব-১১ ডিএডি মাহমুদুর রহমান।
সোহেল ইয়াবা বিক্রেতা বলে র্যাব দাবি করলেও তার বিরুদ্ধে আগের কোনো মামলা কিংবা অভিযোগের তথ্য সোনারগাঁও থানার ওসি মো. মঞ্জুর কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দিতে পারেননি।
ইয়াবা মামলায় সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের হেফাজতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ।
আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে থানায় কোনো জিডি বা মামলা নেই। মেট্রো নিটিং এন্ড ডাইং ফ্যাক্টরির মালিক অমল পোদ্দারের ভাতিজা বাপ্পি পোদ্দার পরিকল্পিতভাবে র্যাব দিয়ে তাকে ফাঁসিয়েছে। তাদের সঙ্গে জমি নিয়ে কারও বিরোধ হলেই র্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার করানো হয়।”
অমল পোদ্দারের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ তুলেই তার প্রতিবিধানে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণে গত রোববার গণভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন আজাদ। তবে পুলিশ বারণ করলে তিনি বাড়ি ফিরে যান।
ওই রাতেই পঞ্চমীঘাট এলাকায় আজাদদের বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। তখন গ্রেপ্তার করা হয় তার চাচাত ভাই সোহেলকে। তাকেও মারধর করা হয় বলে আজাদের অভিযোগ।
গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন সোহেল। তার বাবা নুরুউদ্দিন একজন মুরগি ব্যবসায়ী। পোশাক শ্রমিক আজাদের বাবা আব্দুল খালেক পঞ্চমীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক দপ্তরী।
মঙ্গলবার ওই এলাকায় গিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা হলে তারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোহেলের কোনো খারাপ আচরণ তারা কখনও দেখেননি।
জমি-জমা নিয়ে বিরোধের কারণেই এই যুবককে ফাঁসানো হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তারা।
সাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল রশিদ মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে ছেলেকে ইয়াবাসহ র্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই ছেলে পড়ালেখা করে। সে জীবনে কোনোদিন বিড়ি সিগারেটও খায়নি, অথচ তাকে ইয়াবা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে!”
আজাদ বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। আমাদের ভয় দেখাতে তাকে (সোহেল) ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে।”
র্যাবের ভয়ে এখন লুকিয়ে আছেন বলে জানান এই যুবক; যিনি ‘ন্যায় বিচার চাই’ কাগজে লিখে রোববার সকালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন।
সোহেলকে গ্রেপ্তারের পরও আজাদ হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেন র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান।
তিনি সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “যাকে ধরেছি, সে ইয়াবা ব্যবসায়ী। ওই যুবকের পকেট সার্চ করে ইয়াবা পেয়েছে আমার টিম। পরে তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আরও ইয়াবা পাওয়া গেছে।”
আজাদের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় এই র্যাব কর্মকর্তা বলেছিলেন, “একজন সন্ত্রাসী যখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়, তখন তারা অনেক কিছুই বলে।”
নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করে খুনের মামলায় র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ বাহিনীর তিন কর্মকর্তা আসামি।
ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, প্রধান আসামি নুর হোসেন র্যাবকে অর্থ দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
আজাদদের জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে জড়ানোর অভিযোগ নাকচ করে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক আনোয়ার লতিফ বলেন, “আমরা জমি-জমার কোনো সমস্যা সমাধান করতে যাইনি, তা আমাদের কাজও নয়।”
জমি নিয়ে বিরোধ
আজাদের দাবি, অমল পোদ্দার গ্রামের দরিদ্র কিছু মানুষের ৬০ থেকে ৭০ বিঘা জমি বালু দিয়ে ভরাট করে দখলের চেষ্টা করছেন। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমির মালিকের আক্রমণ ও হুমকির শিকার তারা।
পঞ্চমীঘাটে শিল্প কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন অমল পোদ্দার। তবে কোনো জমি দখলের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
অমল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি কারখানার জন্য বিভিন্ন জন থেকে জমি কিনে নিচ্ছেন। আজাদের বাবা খালেকের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ জমি কেনার জন্য ৫ লাখ টাকায় বায়না করেন। কিন্তু তারা নামজারি না করায় জমিটি রেজিস্ট্রি করা যাচ্ছে না।
আজাদের বাবা খালেক বলেন, দেড় বছর আগে অমল পোদ্দারের কাছে সাড়ে ১৫ শতাংশ জমি ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে প্রতিশ্রুত হন তিনি। বায়না হিসেবে তিনি ৫ লাখ টাকা নেন।
“ওই জমিটি তাদের সীমানার ভেতরে পড়ার কারণে তাদের কাছে আমরা জমিটি বিক্রি করতে রাজি হই। আমাদের মৌখিক শর্ত ছিল, এই জমি দেওয়ার পর আর কোনো জমি দেব না। কিন্তু অমল পোদ্দার ১৯ শতাংশ ও ১১ শতাংশের অন্য দুটি জমি চান। তা না দিলে এই জমি রেজিস্ট্রি করে নিবেন না এবং আমাদের টাকাও দেবেন না বলে আমাদের ঘুরাতে থাকে।”
এর মধ্যে অন্য জমি দুটিও বালু দিয়ে ভরাট করা হতে থাকে এবং বাধা দিলেও অমল পোদ্দার শুনছেন না বলে অভিযোগ খালেকের।
অমল পোদ্দার আরও কয়েকজনের জমি তাদেরকে না জানিয়েই বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ মোল্লা বলেন, “এলাকার লোকজন কয়েক দফা বসলেও তিনি (অমল) কোনো সাড়া দেননি। তার অনেক টাকা-পয়সা হইছে তো, তিনি এখন গ্রামের মানুষকে মানুষ মনে করেন না। তার ভাতিজা বাপ্পি ও সহযোগী সোলেমান এসব অপকর্ম করছে।”
অমল এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমি এলাকার লোকজন থেকে তাদের বেশি দামে জমি কিনে নিয়েছি। কারও এক ফোঁটাও জমিও জোর করে নেওয়া হয়নি বা ভরাট করা হয়নি।”
র্যাব দিয়ে হয়রানির অভিযোগ নাকচ করে তিনি বলেন, “র্যাব কাকে গ্রেপ্তার করেছে, তা আমার জানা নেই। তাদের অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।”