নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একীভূত হওয়া ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের অনেকেই সপরিবারে ভারতীয় নাগরিকত্ব বেছে নিয়েছে।
তাতে বাংলাদেশের নাগরিত্ব বেছে নেওয়া আত্মীয়-স্বজনদের থেকে বিচ্ছেদের বেদনা হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু নিজ পরিবারের সদস্য স্ত্রী-সন্তান-মাতা-পিতাকে রেখে অন্য দেশের নাগরিক হওয়ার যে বিচ্ছেদ তা নিতান্তই দুঃসহ।
এমন ঘটনাই ঘটছে বাংলাদেশের সঙ্গে সদ্য অঙ্গীভূত হওয়া দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে। নাগরিকত্ব বেছে নিতে গিয়ে কাঁটাতারে বিভক্ত হয়ে পড়ছে এই ছিটের বাসিন্দা জয়নাল আবেদিনের পরিবার।
জয়নাল ভারতের নাগরিকত্ব বেছে নিলেও তার স্ত্রী, তিন কন্যা ও বৃদ্ধা মা বাংলাদেশি হিসেবেই থাকতে চান। তবে তার একমাত্র ছেলে বর্তমানে ভারতের নয়া দিল্লিতেই কাজ করছে।
কাঁটাতারের বেড়ায় বিভক্ত হওয়ার এই আয়োজনের মধ্যে এই পরিবারের ঘরের চালার একাংশ উড়ে গেলেও দুই সপ্তাহেও সেই চালাটি ঠিক করা হয়নি।
জয়নাল জানান, তার ১৭-১৮ বছর বয়সের একমাত্র ছেলে বর্তমানে দিল্লীতে একটি ইটভাটায় কাজ করছে। মাস ছয়েক আগে বড় মেয়েকে দাশিয়ারছড়ার বাইরে বাংলাদেশ অংশে বিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়ে ইয়াসমিন পড়ে পার্শ্ববর্তী গঙ্গারহাট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
ভারতীয় ছিটের অধিবাসী এই পরিবারের নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ এলে ভারত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়নাল। তবে বেঁকে বসেন স্ত্রী আকলিমা বেগম।
তবে জয়নাল তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও তার দুই কন্যা মায়ের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর জয়নালের মাও সিদ্ধান্ত নেয় দুই নাতনি ও ছেলের বউকে ছেড়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জয়নাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ভারতীয়, ভারতের সদস্য (নাগরিক)। আমি যাবই যাব।”
আগে মাঝে মাঝে কাজের জন্য ভারত যাওয়া জয়নাল বলেন, “আগেতো যাইতাম। কিন্তু চিরদিনের জন্য যাইতে হইবো। অভাবে পড়ে যখন গেছিলাম, তখন ওতো (আকলিমা) গেছিলো। তাইলে এহন তোর যাইতে কি সমস্যা?
“এখনতো সীমান্ত কড়াকড়ি হয়ে যাবে। আমরা আর সেখানে যেতে পারবো না। তখন কীভাবে চলবো? আমি তাদের বারবার বলছি, তোরা বোঝ, কিন্তু তারা বোঝে নাই।”
স্ত্রী যেতে রাজি না হওয়ায় নিজের জমি বেচে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে জয়নাল বলেন, “তাদের কি হবে আমি জানি না। আমি আমার জায়গাও তাদের ছেড়ে দিয়ে যাবো না। আমার তের শতক জায়গা। এটা আমার বাপের জমি।
“যে বউ আমাকে চাইলো না। তাকে কেন আমি চাইবো? ওপার গেলে আমাকে হয়তো আবার বিয়ে করতে হবে। তখন ভাগিগোষ্ঠী কি তাদেরকে দেখে রাখবে?”
পরিবারের দুই উপার্জক্ষম ব্যক্তিই যদি ভারতে থাকে, তাহলে পরিবারের অন্য সদস্যরা কীভাবে চলবে- এমন প্রশ্নের জবাবে জয়নালের জবাব, “সেটা আমি কেমনে জানবু? তাইতো ওগোরে বোঝাই, চল তোরা। স্বামী নদীতে ঝাঁপ দিলে বউও নদীতে ঝাঁপ দেয়। আমরা ওখানে গিয়া ভালোই থাকমু, চল। কিন্তু তারা যাবি না।”
জয়নালের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পাশে এসে দাড়ান তার বৃদ্ধ মাতা ও মেঝো মেয়ে ইয়াসমিন।
জয়নালের মা বলেন, “আমার গেলে কি হবি। বউ নিয়া যাক, বেটিগোরে নিয়া যাক, আমিও যাব। নয়তো আমি যাব না।”
ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইয়াসমিন বলেন, “আমি জন্মেছি এখানে। আমি এই জায়গা ছেড়ে কেন যাব? আমি যাব না।”
বাবা-ভাইকে ছাড়া থাকতে পারবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াসমিন কেবল দীর্ঘশ্বাসই ছাড়েন। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় নাই।
তবে জয়নালের বউ আকলিমার বলেন, “ও নাম লেখাইছে কেন? জানে না, আমরা যামু না। তাইলে যাবি কেন?
রোববার সন্ধ্যার অন্ধকারে এরপর কেঁদে উঠেন আকলিমা। এক পর্যায়ে জয়নালের সঙ্গে তার আবার ঝগড়া বেঁধে যায়।