এপিপি নিয়োগে কমেছে মামলা নিষ্পত্তি: আইন কমিশন

বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা পরিচালনায় কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টরের পরিবর্তে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ উল্টো ফল দিয়েছে বলে আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2015, 04:32 PM
Updated : 22 June 2021, 09:42 AM

সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে কমিশন বলেছে, ২০০৯ সালে এই পদক্ষেপ নেওয়ার পর মামলা নিষ্পত্তির হার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

এজন্য সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হিসেবে কর্মরত আইনজীবীদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করাকে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। 

মঙ্গলবার সংসদ ভবনে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদনটি জমা দেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।

প্রতিবেদন নিয়ে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করবেন জানিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, মামলা জট কমাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন।

আইন কমিশন প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের আগের পাঁচ বছর এবং পরের পাঁচ বছরে ঢাকার আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হারের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে রয়েছে।

বিচারিক হাকিমের আদালতে ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার জন্য এপিপি নিয়োগ দেওয়া হয়। আগে এপিপি শুধু জজ আদালতেই ছিল, হাকিম আদালতে কাজ করতেন কোর্ট ইন্সপেক্টররা।   

এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি উল্লেখ করে আইন কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “অধিকাংশ আদালতে এপিপিরা নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না বা মামলা পরিচালনায় উৎসাহবোধ করেন না। সাক্ষী উপস্থিত হলে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। যে কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার কমছে।”

ভ্রাম্যমাণ আদালতেও এপিপি নিয়োগের যে প্রস্তাব এসেছে, এই পর্যবেক্ষণের আলোকে ওই প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিরূপণের আবশ্যকতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে আইন কমিশন।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ২৮টি আদালতে ৯৫ হাজার ৯৩৪টি মামলা হয়। এর জন্য ২০ জন কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর (সিএসআই) নিয়োজিত ছিলেন। তারা অভিযোগপত্র জমা হওয়া ৬০ হাজার ৪৯৪টি মামলা পরিচালনা করেন।

এর মধ্যে ২৯ হাজার ৮৪২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। মামলা নিষ্পত্তির হার ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। মামলায় সাজা হওয়ার হার ৫১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

এপিপি নিয়োগের পর ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৪২টি আদালতে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৫৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৮৯ হাজার ৬৬৯টি মামলার অভিযোগপত্র জমা হয়।

আইন কমিশন বলছে, এই সময়কালে মামলা পরিচালনার জন্য ১০০ জন এপিপি নিয়োজিত থাকলেও মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২২ হাজার ৮২৬টি। নিষ্পত্তির হার ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। মামলায় সাজা হওয়ার হার ৪৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।

বাংলাদেশের আদালতগুলোতে মামলা জট কমাতে এর আগেও সংসদীয় কমিটিতে প্রতিবেদন দেয় আইন কমিশন। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য একজন এবং ভারতে ৬৭ হাজারের জন্য একজন করে বিচারক। সেখানে বাংলাদেশে এক লাখ ৫২ হাজার মানুষের জন্য একজন করে বিচারক রয়েছেন।

১৬ কোটি মানুষের জন্য বিচারকের পদের সংখ্যা এখন ১ হাজার ৬৫৫টি। এর মধ্যে ৪৫৭টি পদ রয়েছে খালি।

বর্তমানে বাংলাদেশের আদালতে ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

 

“দেড় হাজার বিচারক দিয়ে এ পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। এই জট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য,” বলেছে আইন কমিশন।

মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে বলে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।

আইন কমিশনের মতে, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রতি ৪০ হাজার মানুষের জন্য একজন করে বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। সেই হিসাবে ১৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য ৪ হাজার বিচারক নিয়োগ করতে হবে।

তবে কমিশন আপাতত দুই হাজার ৪০০ জন বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করেছে।

দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে তাগিদ নিয়েও সতর্ক করেছে আইন কমিশন।

“আশঙ্কা হয় যে, মামলা অতি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যদি সুবিচারের পরিবর্তে তা বিচারহীনতায় পর্যবসিত হয়, সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে। সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।”

সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সাংবাদিকদের বলেন, “মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।”

মামলা জট কমাতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটি বৈঠক করবে বলে জানান তিনি।

“ওই দিন বার কাউন্সিলসহ সকল বার নিয়ে বসা হবে। মামলা জট কমাতে করণীয় নির্ধারণে একটি কনসেনসাস প্রয়োজন। যদি একবারে না হয়, তাহলে পরে আবার বসব।”

মামলা জট কমাতে দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ আইন প্রণেতা।