বিরোধ না থাকলে ছিটের জমি ‘যার দখলে তার’

কোনো আপত্তি না উঠলে ছিটমহলগুলোর জমির মালিকানা যার দখলে আছে, তার হবে বলে জানিয়েছেন ভূমি সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।

সুলাইমান নিলয় কুড়িগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2015, 06:40 PM
Updated : 2 August 2015, 07:23 PM

দাশিয়ারছড়ায় জমি নিয়ে বিরোধে রোববার রক্ত ঝরার পরিপ্রেক্ষিতে রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে একথা জানান তিনি।

দখল নিয়ে বিরোধ থাকলে সেটা অন্যভাবে দেখা হবে জানিয়ে এই জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, “এটা নিয়ে আমরা ১৬ অগাস্ট মিটিং ডেকেছি, বিভাগীয় কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসব, উনারা একটা ওয়ার্ক আউট করেছে, আমরা সেটা আরও দেখব।”

স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের পর ভারতের ১১১টি ছিটমহল এখন বাংলাদেশের মালিকানায় এসেছে, যার আয়তন ১৭ হাজার ১৬০ একর।

বাংলাদেশের মধ্যে থাকা এই ছিটমহলগুলোর ভূমি এতদিন ভারতের হলেও এর বাসিন্দাদের ভূমি লেনদেনের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুযোগ ছিল না।

তবে মুখেমুখে ছিটমহলের জমি অদল-বদল হয়ে আসছিল। বিনিময়ের পর কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় এই ধরনের ১৮ শতকের একটি জমির মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব সংঘাতে গড়ায়।   

ভূমি সচিব বলেন, “দখল বলে এটার (জমির) মালিক হবে। দখল বলেই পাবে। দখল কেউ ডিসপুট করলে সেটা অন্যভাবে দেখার বিষয় থাকবে। আপাতত এটা জেলা প্রশাসকদের কাছে দেওয়া আছে। তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো নেবে।”

এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আকতার হোসেন আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন তারা ছিটমহলগুলো প্রশাসনিকভাবে চিহ্নিত করার কাজ করছেন, পরে অন্য সমস্যা সমাধানে হাত দেবেন। 

“কোন ছিটমহল কোন ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হবে? বড় ছিটমহল যেমন, দাশিয়ারছড়া নতুন একটা ইউনিয়ন হবে কি-না? এ বিষয়ে ঠিক করতে হবে। আমাদের একটা আইন আছে, ইউনিয়ন পরিষদ আইন। সেই প্রক্রিয়া অনুসারে এই এলাকাগুলো কিসের অন্তর্ভুক্ত হবে, সেটা করতে হবে।”

দাশিয়ারছড়া নতুন ইউনিয়ন করার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এলাকার এই কাঠামো ঠিক হওয়ার পর ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সামনে আসবে।”

দাশিয়ারছড়া ছিটমহলের কালিরহাট বাজারের পাশে বিরোধপূর্ণ একটি জমির দখল নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আহত জমির অন্যতম দাবিদার সিরাজ উদ্দিন। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

দাশিয়ারছড়ার যে জমি নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে, সেখানেই ১ অগাস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। তখনই বিরোধের বিষয়টি জেনেছিলেন ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জমিটা ফ্ল্যাগ স্টান্ডের জন্য নির্বাচন করার পর মালিকের সঙ্গে কথা বলি। একজন এসে বলেন, এটা তাদের জমি, ফ্ল্যাগ স্টান্ড করবেন, করেন, কোনো সমস্যা নেই। পরে অন্যপক্ষ এসে বলে, জমিটা তাদের। তবে তারাও ফ্ল্যাগ স্টান্ড করাতে সম্মতি দেয়।

“এক জমির মালিক দুই পক্ষ হয় কীভাবে? এরপর আমি বলি, উভয়ে সম্মতি দিয়েছ, তাই আমরা কাজটা করছি। তবে বিরোধটা আমরা ঠিক করে দেব। এরপরও তারা আজকের এই ঘটনা ঘটনা ঘটাল।”

দাশিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারের পাশের ওই জমি নিয়ে সিরাজ উদ্দিন ও আওয়াল খন্দকারের ছেলেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

সিরাজ উদ্দিনের ছেলেদের দাবি, ওই জমি তারা ৪০-৫০ বছর আহে আওয়াল খন্দকারের কাছ থেকে কিনেছিলেন। অন্যদিকে আওয়ালের বড় ছেলের দাবি, তিনি ওই জমি ছাড়লেও তার ভাইয়েরা অংশীদার থাকায় তার একার সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর নয়।  

ছিটমহল বিনিময়ের আগে শুক্রবার দাশিয়ারছড়ায় উল্লাসের মিছিল, তিন দিন বাদেই সেখানে ঘটেছে সংঘাত

ইউএনও নাসির বলেন, ছিটমহলের অধিকাংশ জমির মালিকানার দাবির পক্ষে কোনো দলিল নেই।

“ভারত থেকে জমির রেকর্ডপত্র পাওয়ার পর আমরা এখানে জমি জরিপ করব। তখন বিরোধগুলোও দেখা হবে।”

ভূমি সচিব বলেন, “মুখে ‍মুখে কেনাবেচা- এটা বিরল ঘটনা। এখন বর্তমান যুগে সামান্য একটা রিকশা বিক্রি করলেও কাগজে লেখাপড়া করা হয়। সেই ধরনের কাগজ অবশ্যই থাকবে।

“আমাদের রেজিস্ট্রার্ড না হোক, সাদা কাগজে বা কিছু একটা তো থাকবে। শুধু মুখে মুখে তো প্রাচীনকালে হত। সেই যুগ তো এখন আর নাই।”

“আমাদের কাছে সিএস রেকর্ড থাকবে, সেটা ধরে ধরে আমরা অগ্রসর হব। এটা কেস বাই কেস দেখতে হবে। সাক্ষ্য প্রমাণ, দলিলপত্র এগুলোর ভিত্তিতে। এসব দেখেই আমাদের কর্মকর্তারা বা তহশিলদাররা ঠিকই তারা খুঁজে নিতে পারে,” বলেন তিনি।

সচিব জানান, একেবারেই কাগজপত্র না থাকলে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিরোধ নিম্পত্তি করা যেতে পারে।

কাগজপত্রহীনরা শঙ্কায়

দাশিয়ারছড়ার সিরাজ উদ্দিনের ছেলে ভারতের স্ট্যাম্পে লেনদেনের কথা জানালেও কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ছোট গাড়লজোড়া-২ ছিটমহলের অনেক বাসিন্দাদেরই কোনো কাগজপত্র নাই।

আলীম উদ্দিন

ওই এলাকার মো. আলীম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সম্প্রতি বলেছিলেন, “১৯৪৭ সালে এখানে হিন্দুরা থাকত। ছিটমহলে থাকতে অসুবিধা হওয়ায় তারা এই জমি বিক্রি করে ভারতের মূল ভূখণ্ডে চলে যায়। চাষের জমি হিসাবে বাংলাদেশিরা এই সব জমি কিনে নেয়।

“আমরা সাতচল্লিশের আগে ‘গয়াবাড়িতে’ (ভারত) থাকতাম। সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলে ‘আজবাড়িতে’ (বাংলাদেশ) আসলাম। এক সময় বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এই জমি কিনি। হিন্দুরা বিক্রির সময় তারা দলিল করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কিনার সময় দলিল করতে পারি নাই। কারণ বাংলাদেশিরা ভারত যেতে পারে না। অন্য কাগজও নাই। মুখবিশ্বাসে এই সব জমি কিনছি।”

আলীমের ছেলে মো. আবু তাহের রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কামাল কন্ট্রাকটর নামে একজনের কাছ থেকে তারা ৮ শতক জমি কিনেছিলেন, তবে ওই বিক্রেতা বেঁচে নেই।

ছিটবাসী কারও কারও কাছে রয়েছে এই রকম দলিল

“কোনো কাগজপত্র কোনো কিছুই নাই। তার ছেলেরা অবশ্য কিছু বলে নাই। দখলিশর্তে জমি কিনেছি। আমাদের দখলেও আছে। কিন্তু একটা আশঙ্কা তো কাজ করেই।”

একই ধরনের জমি রয়েছে মো. মহিউদ্দিনের, যাদের পুরো পরিবার ভারতে চলে যাচ্ছে।

মহিউদ্দিনের ছেলে মো. ওসমান গণি রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের দেড় বিঘা জমি আছে। সরকার বলেছে, আমরা আমাদের জমি বিক্রি করে যেতে পারব।

“জরিপ কখন হবে? এটার সমাধান কখন? কখন আমরা বিক্রি করব? কাগজপত্র ছাড়া জমি কে কিনবে? এই সব প্রশ্নের জবাব আমরা জানতে চাই।”