বিনিময় শেষ হতেই জমি নিয়ে সংঘর্ষ ছিটমহলে

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের এক দিনের মাথায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির দাশিয়ারছড়ায় জমির দখল নিয়ে বিরোধে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2015, 01:43 PM
Updated : 2 August 2015, 05:45 PM

রোববার সকালে দাশিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারের পাশে একটি জমি নিয়ে সিরাজ উদ্দিন ও আওয়াল খন্দকারের ছেলেদের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।

বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে সবচেয়ে বড়গুলোর একটি দাশিয়ারছড়া, অন্য সব কটির মতো এটিও ১ অগাস্ট থেকে বাংলাদেশের, এর বাসিন্দারাও ভারতীয় থেকে বাংলাদেশি হয়েছেন।  

ছিটমহলের বাসিন্দাদের নানা বঞ্চনার মধ্যে ভূমি লেনদেনেরও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে মুখেমুখে জমি হস্তান্তরের প্রচলনে এই ধরনের বিরোধের আশঙ্কা করা হচ্ছিল।  

যে ১৮ শতক জমি নিয়ে এই সংঘাত, সেখানেই শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়েছিল। সংঘর্ষের সময় পতাকার স্ট্যান্ডটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সংঘর্ষে আহত সিরাজ উদ্দিনের বড় ছেলে এমদাদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই জমি ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে তারা আওয়াল খন্দকারের কাছ থেকে কিনেছিলেন।

“তিনি ও আমার বাবা খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। সে সূত্রে এটি কিনেছি। এরপর আমরাই ভোগ দখল করে আসছিলাম। ছিটের অন্য জমিগুলোর মতো এটিও রেজিস্ট্রেশন করিনি।”

৮ থেকে ১০ বছর আগে আওয়াল খন্দকার মারা গেলে তার দুই ছেলে ওবায়দুল হক ও মকসুদুল হকের কাছ থেকে ভারতীয় স্ট্যাম্পে জমি লিখে নিয়েছিলেন বলে দাবি করেন এমদাদ। 

রোববার সকালে আওয়াল খন্দকারের ছেলেরা জমিটির দখল নিতে এলে সংঘাত বাঁধে। এ সময় উভয় পক্ষ লাঠিসোঁটা, বল্লম, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

সংষর্ষে সিরাজ উদ্দিন (৭০), তার ছেলে এমদাদুল হক (৩৮), হারুন অর রশিদ (৩৫), আলেয়া বেগম (২৮), আবুল কালাম আজাদ (৩২), আনিসুল ইসলাম, আবু সিদ্দিক (২৮) ও সাহেরা বানু (২০) এবং আওয়াল খন্দকারের ছেলে আব্দুল হাই (৫০), ওবায়দুল হক (৫২), রাসেল (১৭) ও খায়রুল (২২) আহত হন। তাদের ফুলবাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

ছিটমহল বিনিময়ের আগে শুক্রবার কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় উল্লাসের মিছিল, তিন দিন বাদেই সেখানে জমি নিয়ে ঘটেছে সংঘাত (ফাইল ছবি)

আওয়াল খন্দকারের ছেলে ওবায়দুল হক ওই জমি লিখিতভাবে সিরাজউদ্দিনকে দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও দাবি করেছেন, ‘আবেগাক্রান্ত’ হয়ে তিনি একা জমিটি লিখে দেন। কিন্তু ওই জমিতে তার ভাইয়েরাও অংশীদার।

ওবায়দুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার বাবা বেঁচে থাকতে ওই জমি সিরাজউদ্দিনকে একাধিকবার বর্গা দিয়ে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। 

“গত ৩০ বছরে অন্তত চার থেকে পাঁচ বার এটি আমরা তাদের আদি (বর্গা) দিয়েছি, আবার ফিরিয়ে নিয়েছি। সবশেষ ৭ থেকে ৮ বছর আগে সালিশের মাধ্যমে আদি ফেরত নিয়ে নিই। তারা এ জমিতে গাছ ও বাঁশঝাড় লাগিয়েছিল, সেগুলো কেটে নিয়ে যায়। এরপর থেকে এটি আমাদের দখলে রয়েছে।”

ওবায়দুল দাবি করেন, বছর খানেক আগে একদিন সিরাজ উদ্দিন তার সঙ্গে দেখা করে কান্নাকাটি করলে তিনি ‘আবেগাক্রান্ত’ হয়ে তখন জমিটি লিখে দিয়েছিলেন।

“আমি একটি দোকান করার জন্য এক শতাংশ জায়গা রেখে বাকিটুকু তার নামে লিখে দিই।”

মোট কতটুকু জায়গা লিখে দেওয়া হয়েছিল- জানতে চাইলে ওবায়দুল বলেন, “এটি আমার মনে নেই।

“আর আমি যদি লিখেও দিই তাহলে এটা তো আমাদের তিন ভাইয়ের জমি, আমি একা কিভাবে লিখে দিব?” 

এবিষয়ে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাশিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন বলেন, কালিরহাট বাজারসংলগ্ন ওই ১৮ শতক জমি নিয়ে বিরোধ দীর্ঘ দিনের। পৈত্রিক সূত্রে আব্দুল হাই এবং ক্রয় সূত্রে সিরাজউদ্দিন জমিটি দাবি করে আসছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই দুই পরিবারের মধ্যে শত্রুতা আছে। তবে আমার কাছে মনে হয় জমিটি সিরাজ উদ্দিনদের।

“এখন বাংলাদেশ হয়েছে, তাই আইনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে। দেখা যাক কী হয়।” 

এতদিন ভারতের অধীনে থাকায় ছিটমহলের এসব জমির রেকর্ড সে দেশের হাতে রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫ অগাস্ট দুদেশের ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে দুই দেশের পক্ষ থেকে জমির রেকর্ড বিনিময় করা হতে পারে। এর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মালিকানার প্রশ্ন নির্ধারণ করা হবে। আপাতত ভোগ দখলের ভিত্তিতে জমির মালিকানা বহাল থাকবে।

ফুলবাড়ী থানার ওসি বদরুদ্দোজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো পক্ষ মামলা করেনি।”

কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার তবারক উল্লাহ বলেন, “এটি একটি বিছিন্ন ঘটনা। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দাশিয়ারছড়া ছিটে রোববার অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।”

জাতীয় পতাকার স্থানটিই রক্তাক্ত

দাশিয়ারছড়ার যে জমিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, বাংলাদেশ হওয়ার পর জমি-বিরোধের প্রথম রক্ত ঝরল সেই স্থানটিতেই।

সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত জাতীয় পতাকার স্ট্যান্ডটির সংস্কার চলছে

রোববার দুপুরে জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষে সংঘর্ষের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই ফ্ল্যাগ স্টান্ডটিও, যা উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় আবারও ঠিক করা হয়।

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই জমিটা ফ্ল্যাগ স্টান্ডের জন্য নির্বাচন করার পর জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলি। একজন এসে বলেন, এটা তাদের জমি, ফ্ল্যাগ স্টান্ড করবেন, করেন, কোনো সমস্যা নেই। পরে অন্যপক্ষ এসে বলে, জমিটা  তাদের। তবে তারাও ফ্ল্যাগ স্টান্ড করাতে সম্মতি দেয়।

“এক জমির মালিক দুই পক্ষ হয় কীভাবে? এরপর আমি বলি, উভয়ে সম্মতি দিয়েছ, তাই আমরা কাজটা করছি। তবে বিরোধটা আমরা ঠিক করে দেব। এরপরও তারা আজকের এই ঘটনা ঘটনা ঘটাল।”

ছিটমহলের অধিকাংশ জমির মালিকানার দাবির পক্ষে দলিল নেই জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর কাজ এগুতে হবে।

“ভারত থেকে জমির রেকর্ডপত্র পাওয়ার পর আমরা এখানে জমি জরিপ করব। তখন বিরোধগুলোও দেখা হবে।“