মহাসড়ক আটকে অটোচালকদের বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচলে সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ঢাকার সাভার, নারায়ণগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন অটোরিকশা চালক ও মালিকরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2015, 07:52 AM
Updated : 2 August 2015, 02:19 PM

ফেনীর মোহাম্মদ আলী এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রোববার সকালে বিক্ষোভের সময় পুলিশের সঙ্গে অটোচালকদের সংঘর্ষও ঘটেছে।

অটো চালকদের বিক্ষোভ-অবরোধের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে এবং সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

শনিবার সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অটো চালক-শ্রমিকদের জরিমানা করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

চালকরা ‘না বুঝেই’ আন্দোলনে নেমেছেন মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলছেন, সরকার ওই সিদ্ধান্ত ঠিকই বাস্তবায়ন করবে।

বাংলাদেশের আড়াই লাখ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৫৭০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, আর কোথাও এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। 

অটোরিকশা মালিক-শ্রমিকরা রোববার সকালে সাভার থানা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক

আমাদের ফেনী প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীম জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে অটোরিকশা চালকরা সকাল ১০টার দিকে মোহাম্মদ আলী এলাকায় ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধে।

মহাসড়ক পুলিশের মহিপাল হাইওয়ে থানার পরিদর্শক সালেহ আহম্মদ পাঠান জানান, বিক্ষুব্ধ অটো চালকরা এ সময় ১০/১২টি গাড়িও ভাংচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়।

বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের কারণে মহাসড়কের দুই দিকে যানবাহন আটকা পড়ায় দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা অবরোধ চলার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে পুলিশ প্রশাসন।

বৈঠক শেষে দুই ঘণ্টা পর বেলা ১২টা থেকে যান চলাচল শুরু হয়।

তবে ততক্ষণে মোহাম্মদ আলী থেকে ফাজিলপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কে যানজট তৈরি হয়ে যায় বলে আমাদের প্রতিনিধি জানান।

ফেনীর উত্তরাঞ্চল সিএনজি অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি ও জেলা যুবলীগ নেতা জানে আলম বলেন, “ফিলিং স্টেশানগুলো মহাসড়কের পাশে হওয়ায় গ্যাস নেওয়ার জন্য অটোরিকশাগুলোকে মহাসড়কে যেতে হয়। এ নিয়ে চালকদের সঙ্গে পুলিশের ভুলবোঝাবুঝি ও সামান্য বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল।”

এদিকে অটোরিকশা চালকদের কয়েকজন বলেছেন, মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচলে আপাতত পুলিশ বাধা দেবে না- এই শর্তে তারা অবরোধ তুলে নিয়েছেন।

তবে এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

সংঘর্ষের সময় অন্তত পাঁচ অটোরিকশা চালক ও দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে অটোচালক ও থানার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।  

ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, “মহাসড়কের ফেনী অংশে অটোরিকশা চালকরা অবস্থান নিয়ে থাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”

ধীর গতিতে গাড়ি চলাচল করায় যানজট স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে ফেনীতে দীর্ঘ যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন দূরপাল্লার যাত্রীরা।

হানিফ পরিবহনের যাত্রী লিংকন চৌধুরী জানান, চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য সকাল ৭টায় ঢাকা থেকে বাস ছাড়লেও বেলা ১টায় তিনি ফেনী পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট পোর্ট কানেক্টিং সড়কের মুখে অটোরিকশা চালক-মালিকদের অবরোধে বেলা সোয়া ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।

চট্টগ্রাম অটো রিকশা-টেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের আকবার শাহ থানার সভাপতি মো. ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করে অটো রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা বেকার হয়ে পড়েছে।

“আগে থেকে কোনো ধরনের কর্মসূচি না থাকার পরও বিক্ষুব্ধ চালক-মালিকরা আজ সড়ক অবরোধ করে। এসময় স্থানীয় চেয়ারম্যান ও পুলিশ প্রশাসন উচ্চ পর্যায়ে এই বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।”

মহাসড়কে অটো রিকশার জন্য আলাদা লাইন চালুরও দাবি জানান ফারুক।

চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (সীতাকুণ্ড মডেল থানা) সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মহাসড়কে অটো রিকশা চলতে দেওয়ার দাবিতে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে পোর্ট কানেক্টিং সড়কে চালকরা অবরোধ করে। পুলিশ গিয়ে বুঝিয়ে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।

অবরোধ চলাকালীন সড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটলেও বড় ধরনের যানজট সৃষ্টি হয়নি বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা সাইফুল।

স্থানীয়রা জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধের কারণে সীতাকুণ্ড অংশে যানবাহনের চাপ কম থাকায় যানজট বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি।

আগের দিনের মতো এ মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে রোববারও অটোরিকশা চালক ও মালিকরা অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি মজিবুল হক পলাশ জানান।

বন্দর থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান,  চালক ও মালিকরা সকালে মহাসড়ক অবরোধ করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

“আধাঘণ্টা পর পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবার যান চলাচল শুরু হয়।”

নারায়ণগঞ্জ জেলা সিএনজি অটো রিকশা মালিক সমিতির সভাপতি জামাল হোসেন বলেন, “ সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের এখন পথে বসতে হবে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, এখন তারা কিস্তিও শোধ করতে পারবে না।”

মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দেন তিনি।

সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের তেলিবাজারে অটোচালকদের বিক্ষোভ

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিলেট প্রতিনিধি জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে জেলা শহরে বিক্ষোভের পাশাপাশি ধর্মঘট পালন করছেন অটোচালকরা।  

সকাল ৬টা থেকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের রশিদপুর, তেলিবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে অটোরিকশা ও টেম্পো শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখান।

ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে জেলার কোনো সড়কে ‘থ্রি হুইলার’ চলাচল করতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন স্ট্যান্ডে যাত্রীরা গিয়ে অটোরিকশা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন।

বিকল্প যান হিসেবে বাস ও লেগুনায় করে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন তারা। অনেক যাত্রীকে মাইক্রোবাস ভাড়া করেও যেতে দেখা গেছে।

সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও তিন চাকার বাহনের জন্য মহাসড়কে আলাদা লেইনের দাবিতে তাদের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মুশফিকুর রহমান বলেন, “শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচি চলছে। মহাসড়কগুলোতে অটো চলাচল বন্ধ থাকলেও অন্য যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।”

নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পুলিশি বাধার মধ্যেও রোববার সকাল থেকে অটোরিকশাসহ তিন চাকার গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে বলে আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি বেনজির আহমেদ বেনু জানিয়েছেন।

সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নরসিংদী সদর উপজেলার পাচঁদোনা এবং রায়পুরা উপজেলার নীলকুঠিতে বিক্ষোভ করেছেন রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা।

নরসিংদীর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মোস্তাক সরকার বলেন, “কেউ জোর করে মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি চালাতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।”

অটোরিকশা চালক আব্দুর রহমান বলেন, কিস্তিতে গাড়ি কিনে তিনি বিপাকে পড়েছেন। গাড়ি চালাতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে ‘উপোষ থাকার’ উপক্রম হয়েছে।

উত্তরবঙ্গের তিন মহাসড়ক

নিষেধাজ্ঞা জারির পর দ্বিতীয় দিনে সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপাড় সংযোগ মহাসড়ক, বগুড়া নগরবাড়ি মহাসড়ক, হাটিকুমড়ুল-বনপাড়া মহাসড়কে আগের তুলনায় অনেক কম অটোরিকশা চলতে দেখা গেছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জেলা প্রতিনিধি ইসরাইল হোসেন বাবু জানিয়েছেন।

তিনি জানান, নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে রোববারও হাটিকুমরুল গোলচত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন অটো মালিক-শ্রমিকরা।  

মহাসড়কের পরিস্থিতি দেখতে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দিন আহম্মেদ সকালের দিকে সিরাজগঞ্জ আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন বলে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন জানান। 

তিনি বলেন, “মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল অনেক কমে গেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে হাটিকুমরুল মোড় পর্যন্ত ব্যস্ততম ২২ কিলোমিটার সড়কে দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। দুপুর পর্যন্ত তিনটি মামলাও হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”

হাটিকুমরুল অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্তে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্ত বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় আমরা বিপাকে পড়েছি। বিকেলে হাটিকুমরুল গোলচত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে।”

অটোরিকশা মালিক-শ্রমিকরা রোববার সকালে সাভার থানা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে।

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক

মহাসড়কে অটোরিকশা ও টেম্পোসহ তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে মালিক ও শ্রমিকরা।

ঢাকা জেলার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রাসেল শেখ জানান, অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিকরা রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সাভার থানা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এতে ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। 

প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধের ফলে মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে আবার গাড়ি চলাচল শুরু হয় বলে এএসপি রাসেল জানান।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অটোরিকশা চালক জলিল হোসেন আমাদের সাভার প্রতিনিধি সেলিম আহমেদকে বলেন, “প্রতিবছর আমরা ট্যাক্স দেই, আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন আছে। তাহলে ব্যটারির গাড়ির মত আমরা কেন অবৈধ হব?”