নিষেধাজ্ঞায়ও মহাসড়কে ‘তিনচাকা’

মহাসড়কে ধীরগতি ও তিন চাকার সব ধরনের যানবাহন চলাচলে সরকারের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের প্রথম দিনে বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে জরিমানা করা হলেও অধিকাংশ রাস্তায় অটোরিকশা ও টেম্পো চলেছে দেদারসে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2015, 05:00 PM
Updated : 1 August 2015, 05:00 PM

কোথাও কোথাও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দাবিতে হয়েছে অবরোধ, বিক্ষোভ করেছেন মালিক-শ্রমিকরা।

তবে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিএ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কয়েকটি যান আটক ও চালক-শ্রমিকদের জরিমানা করেছে।

মহাসড়কে কম গতির এসব যানকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে দীর্ঘদিন ধরে তাদের চলাচল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল বাস মালিক ও চালকরা।

গত বছর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ১০ জেলার মহাসড়কে শ্যলো ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার বাহন নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি না চালানোর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। কিন্তু অটোরিকশা ও নছিমন চালকদের আন্দোলনের মুখে তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এরপর পহেলা অগাস্ট থেকে সারাদেশের মহাসড়কে অটোরিকশা, টেম্পোসহ অযান্ত্রিক সব যান নিষিদ্ধ করে গত ২৭ জুলাই সরকার ওই প্রজ্ঞাপন জারি করে।

বিস্তারিত প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক:

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে চলাচল নিষিদ্ধ যানবাহন আটক ও চালকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যব্স্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. ইয়াকুব।

চলাচলে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ ও প্রত্যাহার দাবিতে মহাসড়কে সোনারগাঁওয়ের মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা ও শিমরাইল এলাকায় বেশ কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে সিএনজি চালিত অটোরিশার চালক ও মালিকরা।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া জানান, শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এ মহাসড়কে কয়েক দফা এসব অবরোধ হয়, যাতে প্রায় ২০ মিনিট যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশ গিয়ে মহাসড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে বিপাকে পড়েছেন দাবি করে জেলা অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি জামাল হোসেন বলেন, সিএনজি স্টেশনগুলো মহাসড়কের পাশে; তাই গ্যাস নিতে হলেও চালকদের মহাসড়কে উঠতে হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে অটোরিকশা

এছাড়া নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে যেতে হলে বিকল্প পথ না থাকায় মহাসড়কে উঠতেই হয়। তাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জাননা তিনি।

একই মহাসড়কের ফেনী অংশের অটোরিকশা-টেম্পো চালকরাও একই অভিযোগ করেছেন। ফেনী অংশে প্রথম দিন অবাধে ধীরগতির তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতেও দেখা যায়।

ফেনীর অটোরিকশা চালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “জেলা শহর থেকে শহরতলীর বিভিন্ন ইউনিয়ন ও বিভিন্ন উপজেলায় মহাসড়কের উপর দিয়েই চলাচল করতে হয়। তাই বিকল্প পথ ও পরিবহনের ব্যবস্থা না করে মহাসড়কের উপর তাদের গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব নয়।”

গাড়ি চালানোর জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করে মহাসড়কের লেমুয়া অংশে চালাচলকারী অটোরিকশা চালক জব্বার আলী বলেন, সকালে গাড়ি চলাচলের জন্য বাধা দিলে তারা পুলিশকে ‘ম্যানেজ মানি’ দিয়ে সারাদিন গাড়ি চালিয়েছেন।

তবে চালকদের ‘ম্যানেজ মানি’র বিষয়টি অস্বীকার করেন মহিপাল হাইওয়ে থানা পুলিশের পরিদর্শক সালেহ আহম্মদ পাঠান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফেনী অংশে হাইওয়ে পুলিশের তিনটি দল সকাল থেকে মহাসড়কে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

তিনি দাবি করেন, তারা বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ১০টি অটোরিকশা আটক করেছে। জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকেও একটি মোবাইল টিম কাজ করেছে।

চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ভেল্লাপাড়া ক্রসিং এলাকায় মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন।

সমাবেশ থেকে ৪ অগাস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মানববন্ধন, ৯ অগাস্ট চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ এবং ১৩ অগাস্ট চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরে ধর্মঘট কর্মসূচি ঘোষণা করেন তারা।

সমাবেশে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডোরেশনের আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক অলি আহমদ বলেন, “এ সিদ্ধান্তের ফলে সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে, যাতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

‘অটোরিকশার জন্য দুর্ঘটনা হয় তা সত্য নয়’ দাবি করে শ্রমিক ফেডারেশনের আঞ্চলিক কমিটির কার্যকরী সভাপতি রবিউল মাওলা বলেন, “অটোরিকশা বন্ধ হওয়ার পর যদি কোনো দুর্ঘটনা হয় তাহলে মন্ত্রী পদত্যাগ করবেন কি না তা আমাদের জানাতে হবে।”

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক:

এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশে ১১টি অটোরিকশার চালককে জরিমানা করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

মহাসড়কের চান্দনা-চৌরাস্তা এলাকায় দুপুরে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ১১টি অটোরিকশার চালককে জরিমানা করা হয়।

বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক মো. নাসির উল্লাহ খান বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত অটোরিকশার ১১ চালকের বিরুদ্ধে  মামলা দায়ের এবং সাড়ে আট হাজার টাকা জরিমানা করেছে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক:

নরসিংদীর উপর দিয়ে যাওয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবাধে নসিমন, করিমন, রিকশা, অটোরিকশা ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে।

সরেজমিনে ঘুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শাহেপ্রতাপ ও পাচঁদোনা এলাকায় নিষিদ্ধ যান চলাচল বন্ধে নরসিংদী জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় প্রশাসনের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেন, সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্য করে এ মহাসড়কে রিকশা ও অটোরিকশা চললেও রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা বন্ধ করা হচ্ছে না।

উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ-বগুড়া:

উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ গোলচত্বরে বেলা ১২টা পর্যন্ত চলাচল নিষিদ্ধ যানবাহন অবাধে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। তবে সাড়ে ১২টা থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত মহাসড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কামরুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত মহাসড়কের ছয়টি পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৫২টি অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং ৫৩টির কাছ থেকে ১৮ হাজার ২৬০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে।

এছাড়া শাহজাদপুরে ৪০টি অটোরিকশা জব্দ এবং রায়গেঞ্জর চান্দাইকোনায় অবৈধভাবে মহাসড়কের উপরে গড়ে উঠা একটি সিএনজি স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করা হয়েছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিকল্প পথ তৈরি না করে মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করে হাটিকুমরুল অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, “সরকারের সিদ্বান্তে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্ত আমাদের জন্য বিকল্প রুট তৈরি করে দিতে হবে।”

 

তবে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পুলিশ টাকার বিনিময়ে মহাসড়কে উঠতে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন উল্লাপাড়া থেকে হাটিকুমরুলের অটোরিকশা চালক জাহিদ বলেন, “সরকার পহেলা অগাস্ট থেকে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও পুলিশ সাতদিন আগে থেকেই মহাসড়কে উঠতে বাধা দিচ্ছে। আবারও কিছু টাকা দিলে তারাই মহাসড়কে যেতে দিচ্ছে। ”

এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “এককভাবে অভিযান চালালে পুলিশের বিরুদ্ধে অনেকেই অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তোলে। এ কারণে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, বিআরটিএর সমন্বয়ে যৌথভাবে মহাসড়কে অভিযান চালানোর সিদ্বান্ত হয়েছে।

বগুড়ায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের প্রথম দিন শনিবার পুলিশ চেকপোস্টের কারণে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে অটোরিকশা ও ভটভটিসহ কোনো ধীরগতির যান চলাচল করতে দেখা যায়নি।

এসব এলাকা ছাড়াও সরেজমিনে ধুনট-শেরপুর, ধুনট-বগুড়া-গাবতলীসহ আন্তঃ উপজেলার বিভিন্ন রুটেও সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও টেম্পো চলাচল করতে দেখা যায়নি।

সিএনজি স্টেশনগুলো মহাসড়কের পাশে হওয়ায় গ্যাস নিতে না পেরে অভ্যান্তরীণ পথেও তাদের অটোরিকশা চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন গোসাইবাড়ী এলাকার সিএনজি চালিত অটোরিকশা মালিক পিন্টু মিয়া।

জেলা টেম্পো ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা পরিবহন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি আসাদুর রহমান দুলু বলেন, “সিএনজি স্টেশনগুলো সব মহাসড়কের পাশে। মহাসড়কে ওই সব যানবাহন ঢুকতে না পারলে কিভাবে গ্যাস সংগ্রহ করবে।”

তাই সরকারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার দাবিতে রোববার মানববন্ধন এবং সোমবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার কথা জানান তিনি।

যশোরের শার্শায় মহাসড়কে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবাধে চলছে অটোরিকশা-টেম্পো

 

যশোরের শার্শা:

যশোরের শার্শায় বেনাপোল লোকাল বাসস্ট্যান্ড, নাভারন সাতক্ষীরা মোড় ও বাগআচড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে যশোর-বেনাপোল ও নাভারন-সাতক্ষীরা মহাসড়কে অটোরিকশা, টেম্পোসহ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার বাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
এছাড়া নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি ও ব্যাটারি চালিত ভ্যান চলাচল করেছে।

অটোরিকশা চালক ছাবদার আলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের নাভারন সাতক্ষীরা মোড় ও বাগআচড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৭৫টি থ্রি হুইলার ও ৮৫টি নছিমন নিয়মিত যাতায়াত করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব পরিবহনের অনেক চালক বলেন, নাভারন হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই তাদের চলাচল করতে হয়। এই কারণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মহাসড়কে স্বাভাবিকভাবে যান চালাতে পারছেন তারা।

চালকদের এসব দাবির কথা অস্বীকার করে নাভারন হাইওয়ে পুলিশের সার্জন বুলবুল আহমেদ বলেন, “আমাদের অভিযান চলছে। দুই/এক দিনের মধ্যে অটোরিকশা, টেম্পোসহ শ্যলো ইঞ্জিনচালিত নছিমন, করিমন, আলমসাধু, ভটভটি এবং ব্যাটারি চালিত ভ্যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।”