ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেনের মতে, এটা একটা ঐতিহাসিক সময়। দুই দেশের ছিটমহলের মানুষের মানবিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি এটা বাংলাদেশ- ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ঐতিহাসিক।
এখন এটা ভারত বাংলাদেশ অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়েও ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মানচিত্রে ছিটমহল বিষয়টি মুছে গেল পুরোপুরি। বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড।অন্যদিকে ভারত পেল সে দেশের ভেতরে থাকা ৫১টি ছিটমহল যার আয়তন ৭ হাজার ১১০ একর।
কয়েক যুগ ধরে অন্য দেশের ভেতরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছিলেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ, যারা এখন মুক্তির আস্বাদ পাচ্ছেন।
ইতিহাসে এই ছিটমহলের শুরুর দিক সম্পর্কে কোচবিহারের অধিবাসী ও ছিটমহল গবেষক দেবব্রত চাকী তার ‘ব্রাত্যজনের বৃত্তান্ত’ বইয়ে লিখেছেন, ১৬৬১ সালে মীর জুমলা কোচবিহার আক্রমণ করার পর দীর্ঘদিন রাজার সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধ চলে। ওই সময়ে মুঘল অধিকৃত এলাকায় কোচরাজ্যের অনুগত কিছু লোক ছিল, যাদেরকে রাজগীর বলা হত।
রাজওয়ারা মানে রাজার এলাকা। ১৬৬০ সালে পতুর্গিজ পর্যটক ভ্যানদেন ব্রুক পূর্ব ভারতের যে মানচিত্র প্রণয়ন করেন, তাতে ‘রাজওয়ারা’ শব্দটির উল্লেখ করেন। কোচ কামতার নৃপতি মহারাজা প্রাণনারায়ণের দখলীকৃত এলাকাকে তিনি রাজওয়ারা বা রাজিওয়ারা হিসাবে নির্দেশ করেন। ওই মানচিত্রে কোচবিহার শব্দটিরও ব্যবহার করেন।’
অন্যদিকে কোচবিহার রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রথমে সুবে বাংলা পরে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার যে সব বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড দেখা হয়, সেগুলোই মোগলান নামে পরিচিত।
তবে বাংলাদেশি ছিটমহল লেখক এ এস এম ইউনুছের মতে, কোচবিহারের ছিটমহলগুলোকে ইতিহাসে রাজগীর এবং বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোকে মোগলাম বলা হয়।
এই ছিটমহল সমস্যার উৎসে কোচবিহার রাজার সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধের ফল হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন দেবব্রত চাকী।
মুঘল-কোচ রাজার বিরোধের উৎসে তিনি ১৭২৭ সালকে দেখান, যে সময় বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলী খাঁ মারা যান। ওই সময় কোচ রাজা ছিলেন মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণ। মুর্শিদকুলীর পর সুজাউদ্দিনের আমলের কোচরাজার সঙ্গে মুঘলদের সম্পর্কের অবনতি হয়। রাজত্বের উত্তরাধিকার নিয়ে রাজপরিবারেও কলহ বাড়ে।
অভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগে রংপুর ঘোড়াঘাটের নায়েব ফৌজদার সৌলৎ জঙ্গ ১৭৩৬ সালে কোচবিহার আক্রমণ করেন। ঝাড় সিংহেশ্বরের যুদ্ধে উপেন্দ্রনারায়ণ পরাজিত হলে মোগল ফৌজদার দীননারায়ণকে রাজা করেন। পরের বছর ভুটান রাজার সহযোগিতায় উপেন্দ্রনারায়ণ ধলুয়াবাড়ির যুদ্ধে মোগলদের পরাজিত করলে মোগল ফৌজদার কাশেম খাঁ ও দীননারায়ণ রংপুরে পালিয়ে যান।
“যদিও কোচবিহার রাজ্যের দক্ষিণে ছোট ছোট কিছু এলাকা দখলে রেখে মুসলমান সৈন্যরা বসবাস করতে থাকেন। এদের আনুগত্য ছিলো বাংলার নবাবের প্রতি, স্থানীয়ভাবে কাকিনা, কার্যিহাট ও ফতেপুর চাকলার চৌধুরীদের প্রতি,” লিখেছেন দেবব্রত।
তার মতে, মোগলান নামে পরিচিত এই গ্রামগুলোই কালক্রমে কোচবিহারের অভ্যন্তরে অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার ছিটমহলে পরিণত হয়, যা পরে পূর্ব পাকিস্তান, আরও পরে বাংলাদেশের ছিটমহল হিসাবে স্বীকৃত।
অন্যদিকে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ চাকলা তিনটি নাজির শান্তনারায়ণেল নামে কোচবিহারের মহারাজার ইজারাপ্রাপ্ত হলেও ১৭৬৫ সালে দিল্লির মুঘল বাদশাহ শাহ আলমের ফরমান অনুসারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানীপ্রাপ্ত হলে এই তিন চাকলার উপর তাদের আধিপত্য স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।
দেবব্রত বলেন, যদিও এই তিন চাকলায় বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রজা ছিলেন, যাদের অনেকেই মহারাজার জ্ঞাতি, আত্মীয় স্বজন। এদের আনুগত্য ছিলো মহারাজার প্রতি। স্বভাবতই মহারাজার প্রতি অনুগত গ্রামগুলোকে রাজওয়ারা ও বাসিন্দাদেরকে রাজগীর আমে আখ্যায়িত করা হয়।
১৭৮৯ থেখে ১৮০০ সালের মধ্যে সময়ে এই গ্রামগুলোতে কোচবিহার রাজার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে বাকি এলাকা থেকে ইংরেজরা রাজস্ব আদায়ে উদ্যোগ নেয়।
এর আগেই ১৭৭৩ সালে ইংরেজদের সঙ্গে এক চুক্তি অনুসারে কোচবিহার ইংরেজদের মিত্র করদরাজ্যে পরিণত হওয়া কোচবিহার ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতে যোগ দিলে এই এলাকাগুলো ভারতীয় ছিটমহলে পরিণত হয়। ছিটমহলের অধিবাসীরা ভারতীয় নাগরিকের মর্যাদা লাভ করে।
বিশ্বের অন্যান্য এলাকার মতো ভারতেও নানা বৈশিষ্ট্যের ছিটমহল দেখা গেছে বলে অভিমত এই লেখকের। ব্রিটিশ ভারতে পণ্ডিচেরী ও চন্দননগর ছিলো ফরাসি শাসিত ছিটমহল।
দেবব্রত লিখেছেন, “এই ধরনের প্রকৃত ছিটমহল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ করা গেলেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি বিশেষ অঞ্চলে এত সংখ্যক ছিটমহলের উপস্থিতি এককথায় নজিরবিহীন।”
ছিটমহলে এক দেশের মধ্যে থাকা অন্য দেশের মানুষরা আসলে নামেই নাগরিক ছিলেন। কোনো দেশের কোনো সুবিধাই তারা পেতেন না। বিদ্যুৎহীন জনপদে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, ভূমি লেনদেনেও ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, “এখানকার মানুষ গত ৬৮ বছর বন্দি জীবন যাপন করেছে।
“এখন দুই দেশের দায়িত্ব এখানকার মানুষকে একটা বেটার জীবন দেওয়া। তাদের এত কালের বঞ্চনা ঘুচিয়ে দেওয়া।”