ইতিহাসের পাতা উল্টাতে প্রস্তুত দাশিয়ারছড়া

এই দিনটির অপেক্ষা সেই ১৯৪৯ সাল থেকে, যখন দেশভাগের হিসাবে কোচবিহার অঞ্চল যোগ হয়েছিল ভারতের মানচিত্রে। স্বপ্নপূরণের সেই মুহূর্তে উৎসবের জন্য প্রস্তুত ছিটমহলবাসী।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2015, 01:16 PM
Updated : 31 July 2015, 06:21 PM

ভারত ও বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের মানুষের জাতীয়তা বদলে যাবে, অবসান ঘটবে ৬৮ বছরের অপেক্ষার।

কুড়িগ্রাম সীমান্ত থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে ফুলবাড়ী উপজেলার দাশিয়ারছড়া আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় ছিটমহলগুলোর একটি। ছিটমহল হস্তান্তরের বড় আয়োজন এখানেই চলছে।

১ হাজার ৬৪৩ একর আয়তনের দাশিয়ারছড়ার মালিকানা এতোদিন ছিল ভারতের হাতে। বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে থেকেও প্রায় ৯ হাজার বাসিন্দার জাতীয়তা ছিল ভারতীয়।

দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, দাশিয়ারছড়াসহ ভারতের ১১১টি ছিটমহল ১ অগাস্ট প্রথম প্রহর থেকে হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অংশ। একইভাবে ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যাবে।

ছিটমহল হস্তান্তর উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরে জুমার পর দাশিয়ারছড়ার মসজিদে মসজিদে শোকরানা মোনাজাতের আয়োজন করা হয়; পড়া হয় মিলাদ।

মুক্ত হাওয়া শিস দিচ্ছে দাশিয়ারছড়া ছিটমহলে

ছিটমহল বিনিময়ের আগে শুক্রবার কুড়িগ্রামের দাশিয়ারছড়ায় পতাকা মিছিল

ছিটমহল হস্তান্তর কমিটির দাশিয়ারছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাফ হোসেন জানান, রাত ১২টা ১ মিনিটে বাংলাদেশের পতাকা উঠিয়ে ছিটমহল হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। বাড়িতে বাড়িতে জ্বালানো হবে ৬৮টি করে মোমবাতি।

ইতিহাসের পাতা ওল্টানোর সেই মুহূর্তের আগে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পতাকা মিছিলেরও আয়োজন করে ছিটমহলবাসী।

আলতাফ বলেন, “আজকের এই দিনের জন্য আমাদের বাবা দাদারা সারা জীবন অপেক্ষা করেছে। আমরাও জীবনের অধিকাংশ সময় পার করে দিয়েছি।”

দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় এসব ছিটমহলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না। আরেক দেশের সীমানার ভেতরে হওয়ায় হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, স্কুল-কলেজ বা বিচার- প্রশাসনও ছিল না সেখানে।

ফলে ছিটের বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল সীমিত। অনেকেই বাংলাদেশি বা ভারতীয় ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছেন। তবে ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় সরকারি চাকরির সুযোগ তাদের হয়নি।

ছিটমহল বিনিময়ের পর বাসিন্দাদের সেই বঞ্চনার অবসান ঘটবে; দেশের আর সবার মতো এসব ভূখণ্ডের বাসিন্দারাও নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাবেন।

শুক্রবার মধ্যরাতে বদলে যাচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর মালিকানা

ছিটমহল বিনিময়ের আগে শুক্রবার আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে দাশিয়ারছড়ার দিন কাটে উৎসবে

আলতাফের মতে, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান ও শিক্ষার উন্নয়নই এখন এসব এলাকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

“আমরা নিজেরা জমি দিয়ে, নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে এই ছিটে নয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য ঘরও তোলা হয়েছে।”

‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

প্রস্তাবিত মধ্যপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক মাওলানা মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “আমরা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিচ্ছি। অল্প কিছু দিনের মধ্যে স্কুল চালু করা সম্ভব হবে বলে আশা করি।”

দাশিয়ারছড়ার এই শিক্ষককেও শিক্ষা অর্জন করতে বাংলাদেশের ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করতে হয়েছে।

“আমাদের ছেলে-মেয়েরা সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চলেছে। তারা নিজেদের ঠিকানা ব্যবহার করে শিক্ষা অর্জন করবে। শিক্ষা অর্জনের পর নিজের পরিচয় দিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করবে,” বলেন মোফাজ্জল।

ছিটমহল বিনিময় সামনে রেখে দিনভর উৎসবের মধ্যে দাশিয়ারছড়ার বাসিন্দাদের মিষ্টিমুখ।

দাশিয়ারছড়ায় ছিটমহল বিনিময়ের উৎসবে ছিল মেলারও আমেজ

পরিবারের দারিদ্র্য ও ছিটের বাসিন্দা হওয়ার ‘অভিশাপ’ নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির পর স্কুল ছাড়তে হয়েছিল দাশিয়ারছড়ার আনোয়ারুল ইসলাম আকাশকে। ২০০৮ সালে পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে গেলেও কয়েকবছর আগে আবার শৈশবের ঠিকানায় ফিরে আসে এই কিশোর।

“আমি ভালো ছাত্রই ছিলাম। তাই ভাবলাম, আবার লেখাপড়া করি। এবারতো লেখাপড়া কাজে লাগাতে পারব। গত বছর গঙ্গাচড়া হাই স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করেছি। এখন বিজ্ঞান বিভাগে নবম শ্রেণীতে পড়ছি। আমি ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই।”