সাকার ফাঁসির রায়: এবার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা

সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় বহাল থাকায় এবার তার দণ্ড কার্যকরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা শুরু হল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 10:55 AM
Updated : 29 July 2015, 06:40 PM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বুধবার এই রায় ঘোষণা করে।

রায়ের পর রাষ্ট্র ও আসামি- দুই পক্ষই পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য তাদের অপেক্ষার কথা বলেছে।

ওই অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামি রায় পর্যালোচনার আবেদন করতে পারবেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষারও সুযোগ পাবেন। দুটোই নাকচ হয়ে গেলে সরকার দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে।

যুদ্ধাপরাধী দুই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।

সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী রায়ের পর বলেন, “আমার বাবা একজন নির্দোষ ব্যক্তি। আশা করি এই বিষয়টা একদিন না একদিন প্রমাণিত হবে।”

আর আসামির আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে ‘অবশ্যই’ রিভিউ আবেদন করবেন।

চট্টগ্রাম থেকে সাকা চৌধুরীর ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার প্রসঙ্গে টেনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতাকে ‘নির্দোষ’ বলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব।

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ফুলন দেবীও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়া কারও ‘অপরাধ না করার’ প্রমাণ নয়।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সাকা চৌধুরী ‘এখন অপরাধী’ বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “রায়ের পূর্ণ অনুলিপি পেলে তারা চাইলে রিভিউ করতে পারেন। রিভিউয়ের সুযোগ রয়েছে, তবে আমার মনে হয় না, এর মাধ্যমে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কারণ রিভিউ আপিলের সমকক্ষ নয়। এটাতে কেবল বড় কোনো ভুল হলে সেটা ধরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।”

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে।

ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় দেয় আপিল বিভাগ, যাতে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়।

এর প্রায় আড়াই মাস পর ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। অনুলিপি পাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। দুই পৃষ্ঠার ওই ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে ভরে লাল সালুতে মুড়ে ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানালেও আসামিপক্ষের আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ রাতে এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করে দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন।

এর একটিতে রায় পুনর্বিবেচনা আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাস চাওয়া হয়।

এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের আবেদনের শুনানি করে তা নাকচ করে দেয় প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। ওই রাতে ১০টা ১ মিনিটে এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

কাদের মোল্লার পর আপিলে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

একটি সংক্ষিপ্ত আদেশে ট্রাইব্যুনালকে ওই রায় জানিয়ে দেয় আপিল বিভাগ। এর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত হয়নি।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় ‘রিভিউয়ের সুযোগ’ রয়েছে কি-না, সেই প্রশ্ন সামনে আসে কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ের পর।

গতবছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মামলা নিষ্পত্তি করে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখলে আবার ফিরে আসে সেই আলোচনা।

এর মধ্যেই ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। যুদ্ধাপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করা যাবে বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জানায়।

এতে বলা হয়, আসামি ও রাষ্ট্র- দুপক্ষই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।

ওই রায়ে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে দণ্ডিতদের ক্ষেত্রেও আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য (মেনটেইনেবল) হবে। তবে তা আপিলের সমকক্ষ হবে না।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল পরদিন মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে।

তার আইনজীবীরা ৫ মার্চ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়। রায়ে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর ৮ এপ্রিল তা আসামি কামারুজ্জামানকে পড়ে শোনানো হয়। 

রিভিউ আবেদন খারিজের পর প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান এই যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু আসামি প্রাণভিক্ষার জন্য কত সময় পাবেন এবং কতদিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া না থাকায় কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।

কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন।

তবে প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে বেঁধে দেওয়া ৭ থেকে ২১ দিনের সময়সীমা এ মামলার ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য হবে না। আসামি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। 

কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তিনি প্রাণভিক্ষার সুযোগ নেননি। এ কারণে রিভিউ খারিজের দিনই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।  

কিন্তু কামারুজ্জামান সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কয়েক দফা সময় নিলে জটিলতা দেখা দেয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সে সময় বলেছিলেন, ওই সুযোগ নেবেন কি না- তা জানাতে কামারুজ্জামান ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটি ‘মার্সি পিটিশন’ লিখতে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে সেটাই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে তিনি মনে করেন।

রিভিউ খারিজের পাঁচ দিনের মাথায় ১১ এপ্রিল বিকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চাননি।

ওই সন্ধ্যায় আবারও কামারুজ্জামানের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেওয়া হয়। রাত ১০টার পর দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসাবে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছর  ১৬ জুন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায়ই বহাল রাখে আপিল বিভাগ। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে তার দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সাকা চৌধুরী হলেন চতুর্থ যুদ্ধাপরাধী, সর্বোচ্চ আদালতেও যার ফাঁসির রায় এসেছে।

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত হওয়া ২০টি মামলার রায়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫টিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আবুল কালাম আযাদ, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার এবং কিশোরগঞ্জের রাজাকার সৈয়দ মো. হাসান আলী পলাতক থাকায় এ সুযোগ পাননি।

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জব্বারও একই কারণে আপিল করতে পারেননি।

আর শুনানি চলাকালেই জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিল ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করে আদালত।