সাকার ত্রাসের সাক্ষী রাউজানে এখনও ‘আতঙ্ক’

একাত্তরে চট্টগ্রামের রাউজানের যেসব হিন্দুপাড়ায় হত্যা ও গণহত্যার জন্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সর্বোচ্চ শাস্তি হল, সেই এলাকাগুলোতে এখনও রয়েছে আতঙ্ক।

উত্তম সেনগুপ্ত, রাউজান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 08:17 AM
Updated : 29 July 2015, 08:17 AM

বুধবার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সালাউদ্দিন কাদেরের মৃত্যুদণ্ড বহালের আদেশ আসার পর রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী, জগৎমল্ল পাড়া ও ঊনসত্তর পাড়ায় গিয়ে অধিকাংশ ঘর-বাড়ি ভিতর থেকে দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কড়া নেড়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নন কেউই। দুয়েকজন কথা বললেও পরিচয় প্রকাশে অনাগ্রহী। তাদের চোখে-মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ।

রায়ের পর রাউজান সদরে আওয়ামী লীগের পক্ষে আনন্দ মিছিল আর মিষ্টি বিতরণ করা হয়। তবে এ আনন্দ মিছিলে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। এমনকি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া ব্যক্তিদেরও দেখা যায়নি।

একাত্তরে চট্টগ্রামে ত্রাস সৃষ্টিকারী সালাউদ্দিন কাদেরের বাড়ি রাউজান উপজেলার গহিরায়। শুধু সালাউদ্দিন নন, তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ছিলেন।

আপিলের রায়ে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড বহালের ঘোষণা আসার পর রাউজানের জগৎ মল্লাপাড়া, আতঙ্কে স্থানীয়দের বাড়িঘরের দরজা বন্ধ

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও রাউজান-রাঙ্গুনিয়া এলাকা থেকে কয়েক দফায় সাংসদ নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন ও তার ছোটভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও কাদের চৌধুরী পরিবারের দাপটে সব সময় ভয়ে থাকতেন একাত্তরে স্বজন হারানো বা নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের লোকজন।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে কয়টি অভিযোগে সালাউদ্দিন কাদেরের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কুণ্ডেশ্বরী ও জগৎমল্ল পাড়ায় হত্যাকাণ্ড।

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্রকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।

সকালে ঢাকায় রায় ঘোষণার পর কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ভবনের সামনে গেলে দেখা যায় ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। বাইরে সড়কে লোকজনের চলাচলও তেমন নেই। মূল ফটকে দারোয়ান দায়িত্ব পালন করছে। ভেতরে পুলিশ সদস্যরা পাহারায় আছেন।

প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ভেতরে ঢোকা যায়নি। দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গেট খোলা মানা।”

বেলা ১১টার দিকে কুণ্ডেশ্বরী স্কুলে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। ছুটির পর শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে স্কুল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

এসময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা এই প্রতিবেদককে এড়িয়ে যান।

 কুণ্ডেশ্বরী এলাকার অজয় মল্লিক নামের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ রায় রাউজানবাসীর জন্য বিরাট সুখবর। এর চেয়ে বড় সুখবর আর হতে পারে না। ফাঁসির রায় কার্যকরের মাধ্যমে রাউজানবাসী কুলাঙ্গার মুক্ত হবে।”

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল জগৎমল্ল পাড়ায় ৩২ জন এবং ৫ মে ৩ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পথ দেখিয়ে তাদের ওই গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

বেশ কয়েকবছর ধরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও এখনও সেখানকার সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের মাঝ থেকে আতঙ্কের ছাপ মুছে যায়নি।

সকালে জগৎমল্ল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার সব ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কয়েকটি ঘরে বাইরে থেকে তালা দেওয়া।

এর আগে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরও জগৎমল্ল পাড়ার অবস্থা ছিল প্রায় একই রকম।

রাউজান থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বেলা ১২টার দিকে আবারও জগৎমল্ল পাড়ায় যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদকসহ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী।

এসময় ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী জগৎমল্ল পাড়ার বাসিন্দা আশীষ চৌধুরীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন ওসি।

এরপর আশীষ চৌধুরীর ঘরের দরজার একাংশ খুলে ভেতর থেকে কথা বলেন তার স্ত্রী মেরী চৌধুরী।

তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার শ্বশুর (প্রেমাংশু চৌধুরী) ও ভাসুরকে (অনতু চৌধুরী) মেরে ফেলা হয়।”

আপিলের রায়ে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড বহালের ঘোষণা আসার পর রাউজানের জগৎমল্লা পাড়ায় পুলিশ পাহারা, আতঙ্কে স্থানীয়দের বাড়িঘরের দরজা বন্ধ

পুলিশের উপস্থিতিতে বারবার অনুরোধের পরও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি পরিবারটির কোনো সদস্য।

“আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি,” বলেন মেরী চৌধুরী।

ঊনসত্তর পাড়ায় এক দিনে অর্ধশতাধিক হিন্দুকে হত্যার দায়ে সালাউদ্দিন কাদেরের ফাঁসির রায় বহাল থাকলেও সেখানে গিয়ে জগৎমল্ল পাড়ার মতো পরিস্থিতিই দেখা যায়।

রায়ের পর দুপুরে ঊনসত্তর পাড়ায় গিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সঞ্জিত মহাজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রায় নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”

সঞ্জিতের বাবা যোগেশ চন্দ্র মহাজন ও ভাই রঞ্জিত মহাজন শহীদ হন একাত্তরে। তার সদ্য প্রয়াত বড় ভাই সুজিত মহাজন ছিলেন ট্রাইব্যুনালের অন্যতম সাক্ষী।

মহাজন পাড়া ও পালপাড়ায় গিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শহীদ পরিবারের সন্তান বা সদস্য পরিচয় দিতেও ভয় পাচ্ছেন তারা।

তাদের একজন বলেন, “আমরা মাইনরিটি। আজ নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। কিন্তু প্রতিদিন তো আর এলাকায় পুলিশ পাহারা থাকবে না। ভবিষ্যতের বিষয়টি কে দেখবে?”

কয়েকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগের রায়ের পর অনেকে প্রতিক্রিয়া জানতে এসেছিল। কিন্তু এরপর আর তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি।

ওসি প্রদীপ কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক সময় রাউজানের যে পরিবেশ ছিল এখন তা নেই। তারা কেন ভয় পাচ্ছেন সেটা বুঝতে পারছি না।

“আজকে রাউজানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। কোনো ধরনের সমস্যা নেই। পুলিশের সঙ্গে র‌্যাবও বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে।”

রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবি বলেন, “এ রায়ের মধ্য দিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেনের রাউজান আজ কলঙ্কমুক্ত হল।”

“স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দুকে হত্যা করে চট্টগ্রামে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর অনেক যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করে রাউজানে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তার ফাঁসির রায় বহাল থাকায় রাউজানবাসী খুশি।”

এসময় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বসিত দেখা যায়।

২০১৩ সালে বিএনপিনেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর চট্টগ্রাম শহর ও রাউজানে কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।