সাকার গুডস হিল একাত্তরের ‘টর্চার সেল’

চট্টগ্রাম শহরের গণি বেকারি মোড়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাসভবন ‘গুডস হিল’ এ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরে এনে নির্যাতনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হত বলে নির্যাতিতরা জানিয়েছেন।

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2015, 05:00 AM
Updated : 29 July 2015, 07:58 AM

একাত্তরে নির্যাতিত অনেকেই গুডস হিলের গ্যারেজটিকে ‘নির্যাতন কেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং নির্যাতনের সময় সালাউদ্দিন কাদের, তার পরিবারের সদস্য এবং অনুসারীদের উপস্থিতির বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

একাত্তরে নির্যাতনের কথা স্মরণ করে এখনও শিউরে উঠেন ৭৩ বছর বয়সী সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ম. ছলিম উল্লাহ। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তিনি।  

তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল রাতে স্থানীয় আল শামস বাহিনীর কমান্ডার খোকা, মাহবুবসহ কয়েকজন তাকে রহমতগঞ্জ এলাকা থেকে ধরে গুডস হিলে নিয়ে আসেন।

“আমাদের পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মচারীর খোঁজ নিতে বের হয়েছিলাম। তারা আমাকে ধরে গুডস হিলে নিয়ে এসে নিচতলার গ্যারেজে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে।

“ওইদিন রাতে চোখ বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে আমাকে বেদম পেটানো হয়। ওই কক্ষে আরও একজনকে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন।” 

এছাড়া পাশের কক্ষে আরও অনেককে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই কক্ষ থেকে মানুষের গোঙানির শব্দ শুনেছি।”

পরদিন তার মামা অ্যাডভোকেট আবুল কাশেমের মধ্যস্থতায় তিনি ছাড়া পান বলে জানান ছলিম উল্লাহ।

তিনি বলেন, “সাকা চৌধুরী, তার পিতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীসহ পুরো পরিবারই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। পুরো পরিবারই একাত্তরে চট্টগ্রাম শহর ও রাউজানে নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে যুক্ত।”

আপিলের রায়েও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।

সালাউদ্দিনের যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল ২০১১ সালের ১২ এপ্রিল ‘গুডস হিল’ এ এলে ছলিম উল্লাহ তদন্ত দলের পাশাপাশি উপস্থিত সাংবাদিকদেরও গুডস হিলের গ্যারেজের নির্যাতন কেন্দ্রের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন।

বুধবার যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর চট্টগ্রামের বাড়ি গুডস হিলে কড়া নজরদারি; এদিন মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণা করে আপিল বিভাগ

১৯৭১ সালের ৫ জুলাই গুডস হিলে নির্যাতনের শিকার হন সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাবেক চট্টগ্রাম প্রতিনিধি নিজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাকা চৌধুরীর অনুসারীরা আমাকে তুলে নিয়ে যায় এবং গুডস হিলের নির্যাতন কেন্দ্রে আটকে রাখে। গুডস হিলের ওই নির্যাতন কেন্দ্রে আমার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন।”

ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া নিজাম উদ্দিন বলেন, “৬ জুলাই আমাকে সারাদিন নির্যাতন করা হয়। পরে ১৩ জুলাই আমাকে চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম ক্যাম্পে আর্মিদের হাতে তুলে দেয় সাকা চৌধুরীর অনুসারীরা।”

পরে ক্যান্টনমেন্ট হয়ে তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে একাত্তরের ১৮ নভেম্বর মুক্তি পান নিজাম উদ্দিন।

তিনি বলেন, “গুডস হিলে সাকা চৌধুরী ও তার অনুসারীরা আমাকে ছাড়াও আরও অনেককেই অমানুষিক নির্যাতন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় টর্চার সেল ছিল তাদের পারিবারিক বাসাটি।”

গুডস হিল পরিদর্শনে আসা ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের কর্মকর্তাদেরও একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা জানিয়েছিলেন তিনি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা এবং নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

রাউজানে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর ও ঊনসত্তরপাড়ায় হিন্দু বসতিতে গণহত্যা এবং হাটহাজারীর এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার ছেলেকে অপহরণ করে খুনের দায়ে তাকে ওই সাজা দেওয়া হয়।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় বলে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়।