দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে মেয়রের চেয়ারে নাছির

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ঘাড়ে চেপেছে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার দেনার বোঝা। ‘সংকট’ থেকে উদ্ধার পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন বলে জানিয়েছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। 

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2015, 01:09 PM
Updated : 26 July 2015, 01:58 PM

নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার তিন মাস পর রোববার দুপুরে ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোহাম্মদ হোসেনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন নাছির। এর আগে তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সিসিসির সার্বিক অবস্থা নতুন মেয়রকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

ওই তথ্যচিত্রে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মোট দেনা ছিল ২৯৫ কোটি ২৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। ১৬ জুলাই পরিশোধ করা হয় ৬০ কোটি ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এরপর দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৫ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

দায়িত্ব নেওয়ার পর মেয়র নাছির সাংবাদিকদের বলেন, ওই হিসাব ১৬ জুলাই পর্যন্ত। এরপর দেনার খাতায় আরও প্রায় ১৫ কোটি টাকা যোগ হয়েছে।

“সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ৫০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছেন। দায় দেনার এ হিসাব নিয়ে তার কাছে গিয়ে বলব- আপা, আমার এ অবস্থা। আমাকে উদ্ধার করুন। আশা করি তিনি উদ্ধার করবেন। সবার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করবেন,” বলেন নাছির।

সিটি করপোরেশনের এই হাল আগে থেকে জানতে না পারায় নিজেকেই দোষ দেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির।

“আমরা সব জানি। অথচ সিটি করপোরেশন এত কাছে... তবু এর দশা জানলাম না কেন? তাই এখন নিজেকে দুষছি।”

বৃষ্টির মধ্যেই নগর ভবনে এসে দায়িত্ব বুঝে নেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

 

সেই জলাবদ্ধতা

জলাবদ্ধতার যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীর মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নির্বাচিত হওয়া আ জ ম নাছির উদ্দিন যখন দায়িত্ব বুঝে নিলেন, তখনও চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকা টানা তিন দিনের বর্ষণে জলমগ্ন।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কী করবেন জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ তিনি এ সমস্যা পেয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার আগেই জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণের জন্য পরিচ্ছন্নতা বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

“সীমিত সম্পদ নিয়ে তারা শতভাগ কাজ করেছে। এখন এ দাবি করতে পারি, পানি স্থির থাকছে না, দ্রুত নেমে যাচ্ছে। বহদ্দারহাট এখন আর আগের মত ডুবছে না।”

জলাবদ্ধতার সমস্যাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নিয়েই কাজ শুরু করেছেন দাবি করে নাছির বলেন, “প্রতি বছর কিছু এলাকাকে টার্গেট করে নগরীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেব। সংশ্লিষ্ট সব সরকারি বিভাগকে সম্পৃক্ত করে সুয়্যারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হবে।”

স্লুইস গেইট নির্মাণ ও কর্ণফুলীর ড্রেজিং ত্বরান্বিত করতে বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করার কথাও জানান মেয়র।

তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে করা ‘ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রয়োজনে নতুন আঙ্গিকে সম্ভাব্যতা যাচাই ও ‘মাস্টারপ্ল্যান’ করে কাজ শুরু হবে।

বাঁ থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কাজী শফিউল আলম, নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ইসহাক মিয়া, মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব চালিয়ে আসা মোহাম্মদ হোসেন।

 

মূল সমস্যা ‘শৃঙ্খলায়’

তথ্যচিত্রে জানানো হয়, সিটি করপোরেশনের ৭৩ জন কর্মকর্তা বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে, ২৮ জন চলতি দায়িত্বে এবং ৩৩ জন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সিসিসি পরিচালিত ১৯টি কলেজের সবকটি চলছে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষদের দিয়ে।

জনবল সঙ্কটের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও স্থায়ীকরণ নিয়ে বেশ কিছু মামলার কথাও তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়।

প্রশ্নোত্তর পর্বে মেয়র নাছির বলেন, সিসিসির ‘সত্যিকারের চিত্র’ যারা জানেন না, তারাই জলাবদ্ধতাকে ‘মূল সমস্যা’ মনে করেন।

“আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফেরানো। যাদের দিয়ে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করব তাদের যদি এই দশা হয় তাহলে তা বাস্তবায়ন হবে না। আগে সক্ষমতা অর্জন, পরে পরিকল্পনা গ্রহণ। পাঁচ বছরে যেসব কাজ শেষ করতে পারব বা সন্তোষজনক পর্যায়ে নিতে পারব সেই পরিকল্পনাই নেব।”

জনবল সঙ্কটকেই সিটি করপোরেশনের ‘বড় সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে নাছির বলেন, ১৯৮৮ সালের ‘অর্গানোগ্রাম’ অনুসারে করপোরেশন চলছে। জনসেবা নিশ্চিত করতে আরও জনবল দরকার।

শিক্ষা খাতে করপোরেশনকে বছরে ৩২ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয় জানিয়ে মেয়র বলেন, “এত ভর্তুকি দিলে করপোরেশন চলবে না। ট্যাক্স থেকেও বিগত বছরে এত আয় হয়নি।”

করপোরেশনের আওতাধীন যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ‘অনেক কম’, তা বাড়িয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে বলে জানান মেয়র।

করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ ‘স্থবির হয়ে পড়েছে’ জানিয়ে নাছির বলেন, “কোনো সেবা নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ রাখতে হলে অবশ্যই সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

“মেনন হাসপাতাল প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিল। এখন গেলে নাকে হাত দিতে হয়। এমন বেহাল কেন হল? কমিটি করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

চট্টগ্রামকে ‘বিশ্বমানের বাসযোগ্য নগরী’ এবং ‘মেগাসিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে ‘প্রয়োজনীয় সবকিছু’ করার প্রতিশ্রুতি দেন মেয়র।

দায়িত্ব নেওয়ার আগে নগর ভবনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ মোনাজাতে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে নতুন মেয়র যখন ছাতা মাথায় নগর ভবনে প্রবেশ করেন, তখন বৃষ্টির সঙ্গে ‘পুষ্পবৃষ্টিও’ দেখা যায়।

তিনি করপোরেশনের কেবি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনে প্রবেশের সময় কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ের কারণে ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়েন ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোহাম্মদ হোসেন ও কাউন্সিলর ইসমাইল বালিসহ কয়েকজন।

করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন ঠিকাদার ও বিলবোর্ড ব্যবসায়ীকেও এ সময় মিলনায়তনে দেখা যায়।

বিশেষ মোনাজাত শেষে মেয়রের একান্ত সচিব মঞ্জুরুল ইসলাম সাংবাদিক ও কাউন্সিলর ছাড়া সবাইকে মিলনায়তন ছেড়ে যেতে বারবার মাইকে অনুরোধ করেন।

এতেও কাজ না হওয়ায় মেয়র নিজে মাইক্রোফোন নিয়ে অন্যদের বেরিয়ে যেতে বলেন। পরে মিলনায়তনের দরজা দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ইসহাক মিয়া, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কাজী মো. শফিউল আলম ও সচিব রশিদ আহমদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

গত ২৮ এপ্রিল নির্বাচনে সাবেক মেয়র মনজুর আলমকে দেড় লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন নাছির। এরপর ৬ মে শপথ নিলেও আগের করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের মেয়াদ শেষ না হওয়ায় দায়িত্ব বুঝে নিতে তাকে প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হল।