তারও অর্ধশতাব্দী পর আফগানিস্তানে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘কাবুলিওয়ালাদের’ খুঁজে বেরিয়েছেন বিবিসির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক নাজেস আফরোজ।অবাঙালি পাঠকদের জন্য মুজতবার ‘দেশে বিদেশে’ বইটি তিনি হাজির করেছেন ইংরেজি তর্জমায়।
ভারতে বসবাসকারী আফগান মোস্কা নাজিবকে সঙ্গী করে কলকাতায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া ‘কাবুলিওয়ালাদের’ তিনি তুলে এনেছেন ছবির ফ্রেমে।
সম্প্রতি ঢাকায় হয়ে গেল ‘দেশে বিদেশে’র ইংরেজি অনুবাদের প্রকাশনা উৎসব। পাশাপাশি মোস্কা নাজিবের সঙ্গে তার তোলা ছবি নিয়ে হল আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘কাবুল থেকে কলকাতা’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক শতকে ‘আফগান’ আত্মপরিচয়ের বিকাশ ও প্রকাশ নিয়ে কথা বলেছেন নাজেস আফরোজ।
তার মতে, ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্যের কারণে নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই ‘দেশে বিদেশে’ প্রকাশ করতে ১৯ বছর অপেক্ষা করেছিলেন মুজতবা আলী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি বলছেন, কলকাতার কাবুলিওয়ালাদের মধ্য দিয়ে আপনি কলকাতাকে নিজের শহর হিসেবে আবারও আবিষ্কার করতে চেয়েছেন...
আর কলকাতা তো আপনার শহর
আমি কলকাতায় জন্মাইনি। কিন্তু আমি কলকাতাকে দেখেছি। আমার কলেজজীবন, আমার চাকরিজীবন অর্থাৎ আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের একটা বড় সময় আমি কলকাতায় কাটিয়েছি এবং কলকাতায় সবসময় বৈচিত্র্যময় মানুষের উপস্থিতি আমি দেখেছি। কলকাতাতে অবাঙালি ভারতীয়রা অনেক আগে থেকেই ছিল। এছাড়াও গোটা পৃথিবী থেকে আসা মানুষ, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর একটা বৈচিত্র্য চোখে পড়ত। আশির দশক থেকেই সেই বৈচিত্র্যটা কেমন যেন চলে যাচ্ছিল, বিভিন্ন কম্যুনিটিগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে।
তারা কি ইন্টিগ্রেট করছে? অঙ্গীভূত হচ্ছে বৃহত্তর সমাজে?
না, তারা চলে যাচ্ছে, তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পরে এক সময় মনে হচ্ছিল কাউকে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। এটা আমকে খুব তাগাদা দিচ্ছিল। আমি এটা ধরতে চাচ্ছিলাম।
আপনি এই অনুপস্থিতিটা তুলে ধরতে চাইছিলেন?
হ্যাঁ। এই প্রজেক্ট আমাকে একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে। বড় সুযোগ এই জন্য যে, এদের যদি ধরতে পারি তাহলে কলকাতার যে বৈচিত্র্য ছিল অন্তত তার একটা অংশ ধরতে পারব। এটা আমার দিক থেকে একটা মোটিভেশন হিসেবে কাজ করেছে। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটা আমাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই গল্পটায় যেমন দুটি সংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
এদের ছবি দেখে মনে হয় যে আপনারা তাদের ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ লাইফ’ ক্যাপচার করার চেষ্টা করেছেন। জীবনের মুহূর্তগুলো উঠে আসছে; কিন্তু একই সঙ্গে প্রতিটা ছবির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বাস্তব ও কল্পনা।
প্রত্যেকটাই আলাদা গল্প হয়ে উঠছে।
ছবিগুলোর প্রত্যেকটাই জীবনের ছোট ছোট মুহূর্ত, আবার ছোট ছোট গল্প। আসলে এটাই কি করতে চেয়েছিলেন?
আসলে এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গেছে। আমরা প্রথমে জানতাম না যে এরা আছে কোথায়। যেমন আমি কলকাতায় ছিলাম এ জন্য জানি এরা আছে, কিন্তু সংখ্যা কত? তারা আমাদের কাজে সহযোগিতা করবে কি না। তারা নিজেদের সম্পর্কে বলতে চাইবে কি না, ছবি তুলতে দিতে রাজি হবে কি না—এসব বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমাদের।
আমরা তাদের বিস্তারিত বললাম… আর একটা বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই কম্যুনিটিটা বেশ ছোট এবং তাদের সম্পর্কে নানা রকমের ভুল ধারণাও প্রচলিত ছিল। নামেই একটা ভুল ধারণা তৈরি হয় তাদের সম্পর্কে। সবাই মনে করে এরা কাবুলের বাসিন্দা। কিন্তু এরা গত কয়েক জেনারেশন ধরে আফগানিস্তানে নেই। কিন্তু একটা সময়ে বিষয়টা বোঝানো সম্ভব হয়েছে। ওরা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। তাদের মধ্যে হতাশা আছে, আনন্দ আছে, দারিদ্র্য—সবকিছুই আছে। প্রথমে যখন ছবি তুলতে শুরু করলাম তারা বেশ সচেতন হয়ে উঠছিল। যে রকমভাবে আমরা পোট্রেট ছবি তুলি, সেভাবে কাজ করতে যাওয়ায় তারা আড়ষ্ট হয়ে পড়ছিল। এক সময় তাদের বললাম, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াব। আমরা তোমাদের বাড়ি যাব, তোমরা খাচ্ছ, তার ছবি তুলব। তোমরা ঘুমাচ্ছ, তোমাদের ঘুমের ছবি তুলব। তোমাদের সকালের নাস্তা করার ছবি তুলব।’
একদম ভেতর মিশে গিয়ে ...
আর এটা করতে গিয়ে দেখা গেল, অনেকটা সহজ হয়ে গেছে তারা।
কলকাতার মানুষ তাদের 'আদার' হিসেবে দেখেছে, একইভাবে বাঙালিরাও তাদের জন্য 'আদার' হিসেবেই অস্তিত্বশীল। তাদের মধ্যে সেই টানাপড়েন কতটুকু চোখে পড়েছে?
তারা কলকাতায় থাকছে, কিন্তু আফগান জীবনধারা ছাড়েনি, সেটা আছে এবং পুরোপুরিই দৃশ্যমান—
হ্যাঁ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এমন না যে তারা পাঁচ-দশ বছর হল এসেছে। এই কম্যুনিটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দেড়শ বছরের উপর। আমার হিসেবে এরা আঠার শতকের ত্রিশ বা চল্লিশ দশকের দিকে কলকাতায় এসেছে। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটা প্রকাশিত হয়েছে ১৮৯২ সালে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ১৮৬১ সালে অর্থাৎ তার ৩১ বছর বয়সে এই গল্পটা প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পটা তিনি শুধু একটা ভালো এনকাউন্টার থেকে লিখেছেন, তা বলা যায় না। তাদের তিনি ভালোভাবে দেখেছেন, অবজার্ভ করেছেন তারপর গল্পটা বেরিয়েছে।
এই যে আমির খাঁর কথা বলছিলাম। আমির খাঁর বাবা আফগানিস্তানের, মা ভারতীয়। তার জন্ম কলকাতায়, যে ঘরে তার ছবিটা তোলা হয়েছে সেই ঘরেই তার জন্ম। তার বয়স পঞ্চাশ বছর। জীবনে কোনোদিন আফগানিস্তান যাননি। আশ্চর্যের বিষয় এবং আমাদের চিন্তা করতে খুব সাহায্য করেছে তা। যেভাবে তারা একসঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তারা মেটায়, যেভাবে খাওয়া দাওয়া করে। একটা ছবি আছে একসঙ্গে বসে খাচ্ছে। দৃশ্যগুলো আমরা দেখেছি। তাদের অনেকেরই জন্ম কলকাতায়। তারপরও একটা প্লেট থেকে সবাই খাচ্ছে, যেটা আফগানদের একটা নিজস্বতা। এঁটোকাঁটা বা ঝুটাজাতীয় বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের। এটাকে কেমন করে ধরে রেখেছে? এটা একটা বড় বিস্ময়।
সংস্কারগুলো তারা লালন করছে অন্য একটা দেশে থেকেও। অনেকটা যেন নিজেদের একটা কল্পিত সীমানার মধ্যে বসবাস—
হয়ত সে আফগানিস্তান যেতে পারছে না, সে আফগানিস্তানকে চেনে না, জানে না। কিন্তু এসবের মাধ্যমেই তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করে নিজেদের। তারা কল্পনাতেই আফগানিস্তানে চলে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানে কি আসলে যেতে চান তারা?
এখন যে অল্প কজন যাতায়াত করে, তারা কাবুল হয়ে যাতায়াত করেন ঠিকই। কারণ হচ্ছে প্লেনে যাতায়াতের সুবিধা বেড়েছে। কিছু লোক যাতায়াত করে; যারা পরে এসেছে। ২০-৩০ বছরের মধ্যে এসেছেন যারা, তাদের পাসপোর্ট আছে। কিন্তু যারা খুব পুরনো তাদের কোনো ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট নেই, পাসপোর্ট নেই। তারা কোনোদিন কাবুলই দেখেননি। আমির খাঁর হয়ত আছেন, কিন্তু বাকি যারা জন্মেছে এরা প্রমাণ করতে পারে না এরা ভারতে জন্মেছে। কারণ এদের জন্ম হয়েছে বাড়িতে। পুলিশ যখন জানতে চায়, তখন নিজেদের আফগান হিসেবে পরিচয় দেয় তারা। তখন তাদের যে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা, পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার আছে তাদের, এসব আর তারা পায় না। কর্তৃপক্ষের কাছে তারা প্রমাণ করতে ব্যর্থ যে তারা ভারতে জন্মেছে।
জন্ম সনদ বা এ জাতীয় কিছুই নেই—
কারণ তারা বাড়িতে জন্মেছে…
একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায়… আসলে তারা একটা ‘লিম্বোর’ ভেতরে ঝুলে আছে।
ঝুলে আছে… ফলে অনেকেই চেয়েছে… যেমন—মূল ছবিটার (প্রদর্শনীর) ভদ্রলোক দশ-বারো বছর বয়সে, ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে এসেছিলেন। এসে আটকা পড়লেন। আর যেতে পারেননি। তিনি তো ভারতীয় নন, তার কোনো পাসপোর্ট নেই।
ভূ-রাজনৈতিক চক্রের মধ্যে আটকে গেছেন…
হ্যাঁ। বলা যায়, পৃথিবীর ইতিহাস তৈরিই হয়েছে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে। অভিবাসনের মাধ্যমে। এই ভূখণ্ডে প্রথম এসেছিল আর্যরা; ইউরোপ থেকে। তারপর আরও কত জাতি এসেছে, থেকে গেছে। এরাও সে রকম। হয়ত পাঁচশ বছর পর এদের এই চিত্রটা এ রকমভাবে পাওয়া যাবে না।
প্রথমত একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া যায় না। একটা নেশার মতো ভাব তৈরি হয়। বইটা আমি প্রথম পড়েছিলাম সতের কি আঠার বছর বয়সে। অবশ্য মুজতবা আলীর ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘চাচা কাহিনী’ আরও আগে পড়েছি। মুজতবা আলীর ফ্যান হওয়া যাকে বলে, সেটা তের-চৌদ্দ বছর বয়সেই ঘটেছে। কিন্তু সতের-আঠার বছর বয়সে আমি প্রথম ‘দেশে বিদেশে’ পড়ি। দেশে-বিদেশে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তানে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে আমার। সেই সুযোগটা পরে হয়েছে। কিন্তু এখনও একই রকমের নেশা জাগায় বইটা। আমি প্রতি বছরই দুতিনবার পড়ি। সে হিসেবে গত ত্রিশ-বত্রিশ বছরে একশরও বেশিবার পড়া হয়েছে বইটা।
‘দেশে বিদেশে’ অনুবাদটা প্রকাশের কথা ভাবিনি। ‘দেশে বিদেশে’ থেকেই আফগানিস্তান সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মায়। তারপরে আফগানিস্তান সম্পর্কে আরও চর্চা, পড়াশোনা হয়েছে। আমি প্রথম আফগানিস্তান যাই ২০০২ সালে। আফগানিস্তানে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তারা আফগান বা নন-আফগান কিন্তু আফগানিস্তান নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন—তারা আমার আগ্রহ দেখে খুব অবাক হয়েছেন। আমি বইটার কথা বলতাম তাদের। বইটার অনেক গল্প শোনাতাম তাদের। আবদুর রহমানের গল্পটাও বলেছি। শুনে তারা বইটার অনুবাদ আছে কি না জানতে চায়। বলে—‘আমরা পড়তে চাই’।
তাদের জানালাম, এটার অনুবাদ নেই। আরও বলি, বইটার অনুবাদ করা অসম্ভব। এভাবে বছর দশেক চলে। তারপর কয়েক বন্ধু তাদের জন্য অনুবাদ করে দিতে বলে। এদিকে সেই সময়টায় আমি বিবিসি ছাড়ব ছাড়ব করছি। আমার হাতে সময়ও ছিল। ঠিক করলাম, শুরু করা যাক তাহলে। সুতরাং আমি যখন অনুবাদ করতে বসি, এটা প্রকাশ করব ভেবে করিনি। আমি করেছিলাম শুধু আমার আফগান, নন-আফগান বন্ধু-বান্ধবের জন্য। শুধু তাদের কথা ভেবেই এই কাজ শুরু করেছিলাম। একসময় এটার যখন অনুবাদ শেষ হল, রাফ করলাম, ছয় মাস ফেলে রাখলাম। তারপর আবার কিছুটা ঘষামাজা করে তাদের পড়তে দিলাম।
এদের মধ্যে ইংরেজও আছে, ভারতীয়, অবাঙালি ভারতীয়, আফগান আট-দশজন পড়ে প্রচণ্ড প্রশংসা করেন এবং বই আকারে প্রকাশের দাবি করেন। তাদের ভাষায়, ‘প্রকাশ না করাটা অপরাধ’। তখন আমি পাবলিশার দেখতে শুরু করলাম এবং আমি ভাগ্যবান যে ভালো পাবলিশারই পেয়েছি।
ভাষার কথা বলছিলেন, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষা খুবই স্বতন্ত্র। অনেক ইডিয়ম ব্যবহার করেন
বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার তিনি করতেন। ১২টা ভাষা জানতেন। তার মধ্যে ভারতের পাঁচটা, বাদবাকি বিদেশি।
চ্যালেঞ্জিং তো ছিলই। সবটুকু কি করা সম্ভব? বোধকরি কোনো অনুবাদেই সম্ভব না। কিন্তু তারপরও অনুবাদ সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনুবাদ সাহিত্য না হলে আমরা দস্তয়ভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কি পড়তে পারতাম না। ‘মা’ রুশ ভাষায় কীভাবে লেখা হয়েছে জানিও না। সেটা আমাদের ইংরেজি অনুবাদে পড়তে হয়েছে। সুতরাং এটা জরুরি, কারণ এই ধরনের যারা বড় মাপের লেখক, তারা যে ভাষাতেই লিখুক, সেই ভাষার বাইরে তাদের পরিচয় থাকা উচিত, সেখানে অনুবাদ ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিতে হবেই।
যেমন উদাহরণ দিয়ে বলছি, মীর আসলাম নামে একটা চরিত্র আছে। মীর আসলাম প্রথমে যখন কথা বলছেন, সেটা খুব পুরনো ধাঁচের ফারসি। মুজতবা আলী সেটা বাংলায় যেভাবে লিখেছেন সেটা তো ইংরেজিতে করা সম্ভব না। কিংবা দোস্ত মোহম্মদ বলছেন যে, ‘এই যে ভাই তুমি আমাকে আপনি-আজ্ঞে করছ। এটা তো বেশিদিন করতে পারবে না। আমাকে তুমি বলতেই হবে। সবাই আমাকে তুমি করেই সম্বোধন করে। আমার চাকরও আমাকে তুমি বলে, কিন্তু তুমি আমাকে আপনি বলছ।’ এটা তো সম্ভব না। কারণ ফারসিতে আছে, কিন্তু ইংরেজি ভাষাতে তুমি, আপনি নেই। আবার কিছু জিনিস হয়ত বাড়তি কথা বলে বোঝাতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত যে কয়জন পড়েছেন তারা সবাই মনে করছেন, মুজতবা আলীর মধ্যে যে স্পিরিটটা, তার যে একটা ভীষণ হাস্যরস, সেটা এসেছে।
আবার অনুবাদের কথা শুনে অনেকেই বলেছেন, সৈয়দ মুজতবা আলী অনুবাদ করা সম্ভব? কখনও সম্ভব না। আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, যারা বাংলায় মুজতবা আলী পড়েন, তারা বাংলাতেই পড়বেন। আমার মুখ্য উদ্দেশ হচ্ছে, যারা মুজতবা আলী সম্পর্কে জানেন না, তার পাণ্ডিত্য সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তাদের কাছে মুজতবা আলীকে তুলে ধরা।
আপনি আফগানিস্তানকে আবিষ্কার করেছেন তার লেখার মাধ্যমে, এটা মনে হয় মুজতবা আলীর অনেক পাঠকের বেলাতেই সত্যি। আফগানিস্তান সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যে স্টিরিওটাইপ সবসময় কাজ করে, সেই স্টিরিওটাইপটা মুজতবা আলীর লেখা পড়ে ভেঙে যায়। আফগান পাঠকরা যখন সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখার মাধ্যমে আফগনিস্তানকে দেখতে পেলেন, তাদের প্রতিক্রিয়াটা কেমন হয়েছে?
আরেকটা ব্যাপার জানতে চাইছি, আপনি নিজেও দীর্ঘসময় কাজ করেছেন আফগানিস্তানে, দেখেছেন আফগানিস্তানকে। মুজতবা আলীর লেখায় যে আফগানিস্তান উঠে এসেছে তার সঙ্গে আজকের আফগানিস্তানের ফারাক কতটুকু?
সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে তো একটা বড় ফারাক হবেই। কারণ, তিনি ছিলেন ১৯২৭ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগের সময়। একটা বড় ফারাক থাকবেই। এর মধ্যে গোটা ভূ-রাজনীতি পাল্টে গেছে। আফগানিস্তানের উপর দিয়েও অনেক ঝড় বয়ে গেছে। এটাকে যদি বাদ দিই, আমরা এই দুটোর একটাকেও যদি না দেখি—তাহলেও কিন্তু ঠিক একই ধরনের চরিত্র দেখতে পাব। বাজারের চেহারা পাল্টেছে কিছুটা, তার বর্ণনা অনুযায়ী ঠিক সেভাবে বাজারও হয় না। কিন্তু দোকান-হাটে আগের মতোই গালিচার উপরে বসে ব্যবসা হচ্ছে। যে সমস্ত জিনিস বিক্রি হত, সেসবও পাল্টে গেছে। কিন্তু যে ধারাতে ব্যবসা হত, সেই একই ধারা বজায় রয়েছে।
সাংস্কৃতিক আবহটাও কি একই রকম আছে?
হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক আবহটাও একই রকম আছে। তিনি যেমন বারবার বর্ণনা করেছেন, আফগানিস্তানের সামাজিক কাঠামোগুলো অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণিভাগই নয়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলো যে কতটা জরুরি, সামাজিক আবহ বোঝার জন্য; সেটা এখনও বিদ্যমান। ভীষণভাবেই বিদ্যমান। জায়গাগুলোর কিছু পাল্টায়নি। আমাদের একই রকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে। একদিনের ঘটনা বলি, বিবিসির কাজের জন্য যে গেস্ট হাউজে থাকতাম সেখানে যিনি রান্না করতেন, তার নাম আবদুর রহমান না, তার নাম ভিন্ন। সে আবদুর রহমানের মতো লম্বাও না, ছোটখাটো চেহারা। একদিন খাওয়ার পর সে এসে ঘরের কোনায় বসে আখরোট ভাঙতে শুরু করল। যেটা আবদুর রহমান রোজ করত। তখন আমার মনে পড়ল সেই ঘরের কোনা, দুই বন্ধু। আমার যে আফগান বন্ধু, তিনিই গেস্ট হাউজের মালিক। আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। আমরা বসে চা খাচ্ছি। সে ঠিক এই সময় ঘরের এক কোনায় বসে আখরোট ভাঙতে শুরু করল হাতুড়ি দিয়ে।
আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ‘দেশে বিদেশে’ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এতদিন আগে…
আশি-পঁচাশি বছর আগে, তিনি লিখেছেন। ফলে আজকে আমানুল্লাহকে নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। অথচ সেই সময়টাতে আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হচ্ছে। বিশেষ করে মোল্লারা আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে চলে গেছে। তাদের বিরোধিতার পেছনে হয়ত বিদেশি শক্তির হাতও থাকতে পারে। সেটা মুজতবা আলী ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। এর কোনো লিখিত চাক্ষুস বিবরণ নেই। এটা কেউ লেখেননি। এটাই একমাত্র চাক্ষুস বিবরণ, আই উইটনেস অ্যাকাউন্ট যাকে বলা হয়। আমার বইটার যিনি মুখবন্ধ লিখেছেন, ন্যান্সি হ্যাচ ডুপ্রি, তাকে আফগানিস্তানের মাতামহী বলা হয়। ভদ্রমহিলা ৫০ বছর ধরে আফগানিস্তানে আছেন। প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ করে হারিয়ে যাওয়া আফগানিস্তান সংক্রান্ত লিটারেচার, গবেষণার প্রচুর ডকুমেন্ট জোগাড় করেছেন… ন্যান্সি এই কথাটাই লিখেছেন। এই বইটা একটা ঐতিহাসিক দলিল। ওই সময়ের আফগানিস্তানের ইতিহাস যতটুকু লেখা হয়েছে তা অন্যান্য কিছু দলিলের উপর ভিত্তি করে। এখানে একেবারে চাক্ষুস দ্রষ্টার বিবরণ পাওয়া যায়।
সেই সময়ে তিনি সেখানে ছিলেন…
ছিলেন এবং লিখেছেন। আর কেউ লিখেননি। সেই হিসেবে এটার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক।
আপনার থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লেখার পরিকল্পনা আছে কি?
দেখা যাক। মুজতবা আলী কাবুল থেকে ফিরেছিলেন ১৯২৯ সাল, লিখেছেন বিশ বছর পর।
এত লম্বা সময় তিনি কেন নিলেন?
সৈয়দ মুজতবা আলীর আর কোনো লেখা অনুবাদের কথা কী ভাবছেন?
ঠিক করিনি এখনও, দেখি। আমার নিজেরও অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। ফটোগ্রাফি, লেখালেখি, হয়ত কোনো একদিন করে ফেলব। বলে রাখি, আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব 'চাচা কাহিনী' অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি প্রেস নামে একটা নতুন প্রেস চালু হল, তার জন্য ওয়ার্কশপ করে ১১ জনকে দিয়ে ১১টি গল্প অনুবাদ করানো হয়েছে। আমি খুব খুশি তাতে। মুজতবা আলীর দু-তিনটা ভালো বই অনুবাদ করে তার সম্পর্কে একটা আগ্রহ তৈরি করা দরকার বাঙালি পাঠকের বাইরে। ভারতের মধ্যে কেবল নয়, ভারতের বাইরেও জানা উচিত তার সম্পর্কে।