চিনুয়া আচেবের গল্প: মৃতদের পায়ে চলার পথ

. মেহেদী হাসানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2013, 03:03 AM
Updated : 6 April 2013, 03:45 AM

অনেকটা হঠাৎ করেই প্রত্যাশিত সময়ের বেশ আগেই মাইকেল অবির স্বপ্নটা যেন পূরণ হয়ে গেল। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতেই সে নিযুক্ত হল নদুম সেন্ট্রাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে। এটা সবসময় ছিল অন্যান্য স্কুল থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া, ঠিক এ কারণেই মিশন কর্তৃপক্ষ মাইকেল অবির মত প্রাণবান টগবগে তরুণ এবং সক্রিয় একজনকে সেখানে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবি বেশ উৎফুল্লতার সাথেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব লুফে নেয়। স্কুলকেন্দ্রিক অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা তার ঘটে জমা ছিল এবং এতে করে এগুলোকে বাস্তবে রূপায়িত করার একটা বড় ধরণের সুযোগ তার হাতের নাগালে এসে যায়। তার ছিল পূর্ণাঙ্গ উচ্চতর শিক্ষা যা তাকে একজন গুণী শিক্ষকের মর্যাদা এনে দিয়েছিল এবং তার স্থানটি ছিল মিশন ফিল্ডের অন্যান্য শিক্ষকের থেকে বেশ উপরে। অন্যান্য বয়স্ক এবং কম শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংকীর্ণ মন-মানসিকতার সমালোচনায় সে ছিল অনেক বেশী খোলামেলা।

পদোন্নতির খবর পাওয়ার আনন্দঘন মুহূর্তে সে তার তরুণী ভার্যাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি বল, আমরা এই সুযোগটাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবো না?”

“আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা করে দেখাবো”, উত্তরে তার বউ জানায়। “আমাদের অনেক সুন্দর বাগান থাকবে এবং সবকিছু হবে আধুনিক এবং আনন্দময়—-”

তাদের দুই বছরের বৈবাহিক জীবনে বউটি স্বামীর “আধুনিক চিন্তা পদ্ধতি” এবং “এখনও শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত বৃদ্ধ ও সেকেলে লোকজন যারা হয়তো অনিস্তা বাজারে ব্যবসা করলেই ভালো করত” তাদের প্রতি বাজে মনোভাবের আবেগ দ্বারা পুরোপুরিভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সে ইতিমধ্যেই তরুণ প্রধান শিক্ষকের গুণগ্রাহী স্ত্রী হিসেবে নিজেকে দেখতে শুরু করে, যেন সে ঐ স্কুলের রাণীর আসন লাভ করেছে।

অন্যান্য শিক্ষকের বউরা নিশ্চয় এখন তার অবস্থানকে হিংসা করতে শুরু করবে। সে এখন থেকে সকল বিষয়ে জাঁক দেখিয়ে চলা শুরু করবে। তারপর হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করে যে, সে ছাড়া অন্য কোন বউ সেখানে থাকবে না। আশা এবং ভয়ের দোলাচলে তার স্বামীর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চায়।

“আমাদের সকল সহকর্মী হবে তরুণ এবং অবিবাহিত,” স্বামীটি হাসিমুখে জানায়। “যা আমাদের জন্য ভালোই হবে, কি বল?” সে বলে চলে।

“কেন?”

“আরে কেন বলছ কি! এতে করে তারা প্রত্যকে তাদের সবটুকু সময় এবং শক্তি-সামর্থ্য স্কুলের কাজে নিয়োজিত করতে পারবে।”

এ কথা শুনে ন্যান্সি, তার বউ হতাশায় চোখদুটি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণের জন্য সে নতুন স্কুলের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে; কিন্তু তা কয়েক মিনিট মাত্র। তার সামান্য ব্যক্তিগত আকাঙ্ষার পরিপূরণ না হওয়া স্বামীর সুখী সুন্দর সম্ভাবনার ব্যাপারে তাকে অন্ধ করে দিতে পারেনি। স্বামীটি যখন আরাম করে চেয়ারে বসেছিল তখন বউটি তার দিকে এক নজর তাকায়। স্বামীটি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসে ছিল এবং তাকে দুর্বল ও নমনীয় দেখাচ্ছিল। কিন্তু সে মাঝে মাঝেই হঠাৎ উত্থিত হওয়া শারীরিক শক্তি দেখিয়ে লোকজনকে হতবাক করে দিতে সক্ষম। যাহোক বর্তমান বসার ভঙ্গীতে তার সকল শারীরিক শক্তিকে মনে হচ্ছিল যেন গভীরতাব্যঞ্জক চোখ দুটির পেছনে গিয়ে আশ্রয় লাভ করে তাদেরকে অনেক বেশী পরিমাণে তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। যদিও তার বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর, তাকে ত্রিশ বা তার চেয়েও অধিক বয়সের দেখাচ্ছিল। অবশ্য সব মিলিয়ে তাকে সুদর্শনই লাগছিল।

কিছুক্ষণ পর নারী বিষয়ক ম্যাগাজিনটি চোখের সামনে মেলে ধরে ন্যান্সি বিড়বিড় করে বলে, “তোমার চিন্তাকে বাহবা জানাই, মাইক”। “আমি ভাবছি, কিভাবে একটা স্কুল পরিচালনা করা উচিত তা ঐ সমস্ত দুর্মুখ লোকজনকে দেখানোর একটা মহৎ সুযোগ অবশেষে আমাদের হাতে এসে পড়েছে।”

স্কুলটি সব রকমভাবেই আগাগোড়া পিছিয়ে পড়া। মাইকেল অবি তার সকল শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সাথে সাথে তার বউটিও। তার মূল লক্ষ্য ছিল দুইটি। উচ্চতর মানের একটি শিক্ষাব্যবস্থা সেখানে চালু করা এবং স্কুল প্রাঙ্গণটিকে সৌন্দর্যময় একটি স্থানে পরিণত করে তোলা। ন্যান্সির স্বপ্নের বাগান এতদিনে বাস্তবের মুখ দেখতে পেল এবং বেশ বৃষ্টিপাতের ফলে কয়েকদিনের মধ্যে ফুলে ফুলে ভরে উঠল। গাঢ় লাল ও হলুদ রঙের উজ্জ্বল শোভায় সুন্দর হিবিস্কাস এবং আল্লামান্ডা তৃণলতার বেড়া স্কুল প্রাঙ্গণটিকে আশে পাশের ঝোপঝাড় থেকে আলাদা করে ফেলে।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় অবি যখন মৌজের সাথে তার কাজ করে যাচ্ছিল তখন হবলি গ্রাম থেকে একজন বৃদ্ধাকে সরাসরি স্কুল প্রাঙ্গণের মাঝ বরাবর ম্যারিগোল্ড ফুলের সারি এবং তৃণলতার বেড়ার ভেতর দিয়ে আসতে দেখে সে যারপরনাই ব্যথিত হয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে, গ্রাম থেকে আসা স্কুল প্রাঙ্গণের মাঝ বরাবর অন্য পাশের বেড়ার ভেতর দিয়ে প্রায় অব্যবহৃত একটি রাস্তার কিছু হালকা নজির তার দৃষ্টিগোচর হয়।

তিন বছর ধরে তার স্কুলে কাজ করে আসছে এমন একজন শিক্ষককে সে বলে ওঠে, “আমি বিস্মিত না হয়ে পারিনা যে ঠিক তোমাদের মত লোকজন গ্রামবাসীদেরকে এই পায়ে চলার পথটিকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছে। না, না, এটা আমি কোনমতেই মেনে নিতে পারিনা”।

শিক্ষকটি তোতলাতে তোতলাতে বলে, এই পথটি গ্রামবাসীদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ইদানিং এটা খুব কমই ব্যবহৃত হয়, এটা গ্রামের ধর্মালয় থেকে স্কুল প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে সোজা তাদের কবরস্থান পর্যন্ত চলে গিয়েছে।

প্রধান শিক্ষক রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, তাহলে আমাদের স্কুলের কি হবে একবার ভেবে দেখেছো?

অন্য শিক্ষকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “তা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার মনে আছে বেশ আগে যখন আমরা এটাকে বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেই তখন বেশ ভালোরকমেই রাস্তাটি বহাল ছিল।”

প্রধান শিক্ষক অবি চলে যেতে যেতে বলে, সেটা বেশ আগে ছিল কিন্তু আমার সাফ কথা এখন থেকে এটা আর ব্যবহৃত হবে না। সরকারী শিক্ষাকর্মকর্তা কি ভাববেন যখন তিনি পরবর্তী সপ্তাহে স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। আমি যতটুকু জানি গ্রামবাসীরা সম্ভবত স্কুল কক্ষকে প্যাগান উৎসবের জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষাকর্মকর্তার পরিদর্শন করার সময়।

ঢোকার এবং স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে বের হওয়ার দুই দিক বড় বড় লাঠি কাছাকাছি পুঁতে পথটিকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হল। বেড়াটাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য তাতে ভালো রকমে কাঁটা তার জড়িয়ে দেয়া হল, যাতে করে ওই পথ দিয়ে আর কেউ কোনভাবেই ঢুকতে না পারে।

তিনদিন পর গ্রামের যাজক এলো প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করার জন্য। সে একজন বৃদ্ধ মানুষ এবং সামান্য কুঁজো হয়ে চলাফেরা করে। সে শক্তপোক্ত একটা হাঁটার-লাঠি হাতে নিয়ে চলাফেরা করে যা দিয়ে সে মাঝে মাঝে মেঝেতে মৃদু মৃদু চাপ দেয়, বিশেষ করে যখন তার যুক্তিমালায় নতুন কোন কথা সে যোগ করে। প্রাথমিক কিছু সম্ভাষণ বিনিময়ের পর বৃদ্ধ যাজক বলতে শুরু করে, “আমি শুনতে পেলাম আমাদের পূর্বপুরুষদের রাস্তাটিকে নাকি কিছুদিন যাবত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”

উত্তরে মাইকেল অবি বলে, “হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন, আমরা নিশ্চয়ই স্কুল প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে লোকজনের সদর রাস্তা বানানোর অনুমতি দিতে পারিনা।”

বৃদ্ধ যাজক হাঁটার লাঠি নিচের দিকে নামাতে নামাতে বলে, “শোন বাবাজী, এই পথটি তোমার এমনকি তোমার বাবার জন্মের পূর্বেও এখানে ছিল। এই গ্রামটি তার পুরো জীবৎকাল ধরেই এর উপর নির্ভর করে আসছে। আমাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনরা এই পথ দিয়ে বের হয়ে যায় এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা এই পথ ধরে আমাদের দেখতে আসে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এটা হচ্ছে সেই পথ যেখান দিয়ে শিশুরা আসে জন্মগ্রহণ করতে।”

মাইকেল অবি মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রেখে শুনে যায়।

অবশেষে সে বলে, “আমাদের স্কুলের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে এসমস্ত কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসকে মানুষের মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা। মৃত মানুষদের কখনো দরকার পড়েনা পায়ে চলার পথ ব্যবহার করার। পুরো পরিকল্পনাটা বেশ মজাদার। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আপনাদের সন্তানদেরকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যাতে করে এসব আজগুবী ধারণায় তাদের হাসি পায়।

মাথা ঝুঁকে বৃদ্ধ জানায়, “তুমি যা বললে তা হয়তো সত্য, কিন্তু আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কার্যকলাপকে অনুসরণ করে চলি। তুমি যদি রাস্তাটিকে খুলে দাও তাহলে এটা নিয়ে আমাদের আর কথা বলার কিছু নেই। আমি যা সর্বদা বলি তা হলঃ একই ডালে পেঁচা এবং ঈগল দুটোকেই বসতে দাও।” বৃদ্ধ যাজক চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।

তরুণ প্রধান শিক্ষক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, “আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আমাদের স্কুল প্রাঙ্গণের ভেতরে কোন সদর রাস্তা থাকতে পারবে না। এটা আমাদের স্কুলের নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে যায়। আপনারা চাইলে অবশ্য আমাদের স্কুল প্রাঙ্গণের পাশ দিয়ে অন্য একটি পথ তৈরি করে নিতে পারেন। এতে আমাদের কোন আপত্তি তো থাকবেই না, বরং স্কুলের ছাত্ররা এই পথটি গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে। আমি মনে করিনা যে, কাছেই আরেকটি পথ খুঁজে নিতে আপনাদের পূর্বপুরুষদের নিশ্চয় তেমন কোন সমস্যা হবে।”

ইতিমধ্যে বাইরে বেরিয়ে আসা বৃদ্ধ যাজক ঘোষণা করেন, “এই বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।”

দুই দিন পর গ্রামের একজন যুবতী নারী সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়। অনতিবিলম্বে সকলে একজন ভবিষ্যৎবক্তার সাথে শলাপরামর্শ করতে বসে যায় এবং পূর্বপুরুষরা গ্রামে ঢুকতে বেড়ার দ্বারা বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তার প্রশমন করতে বড় কিছু উৎসর্গ করার জন্য গ্রামবাসীদেরকে নির্দেশ দান করে ।

পরদিন সকালে মাইকেল অবি যেন তার সকল কাজের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে জেগে ওঠে। তৃণলতা আচ্ছাদিত সুন্দর বেড়াগুলো রাস্তা থেকে অনেক দূরে স্কুল প্রাঙ্গণের একেবারে বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে, ফুলগাছগুলোকে মাড়িয়ে তছনছ করে ফেলা হয়েছে এবং একটা স্কুল দালানকে গুড়ো করে ফেলা হয়েছে। সেই দিনই ইউরোপীয়ান ব্যবস্থাপক স্কুল পরিদর্শন করতে এসে স্কুল প্রাঙ্গণের অবস্থা বর্নণা করে একটি জঘন্য রিপোর্ট পাঠায়। কিন্তু বেশী গুরুত্ব দেয় “স্কুল এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা যুদ্ধাবস্থা বিষয়ে, যা নতুন প্রধান শিক্ষকের অতি কৌতুহলের কারণেই শুরু হয়েছে।”