কবির শ্রেণিচেতনা ও রাসুল গামজাতভের মাই দাগেস্তান

কবি ভুইফোড় কেউ নয়। তিনিও এই দুনিয়াতেই কোথাও জন্ম নেন, বিকশিত হন কোথাও। কোন না কোন জাতির বেদনা, আনন্দ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারাও তার ভেতর প্রবাহিত হয়ে যায়। তিনি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন, নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য। তিনি বিচার করেন নিজের সংস্কৃতি দিয়ে দুনিয়াকে, তেমনি দুনিয়ার সংস্কৃতি দিয়ে নিজেকেও। ক্রমশ তিনি খুঁজে পেতে চান নিজেকে সমগ্রের ভেতর, খুঁজে ফেরেন নিজের অবস্থান। যে কবি যত দ্রুত নিজের অবস্থান সনাক্ত করতে পারেন, তিনি তত দ্রুত তার নিজের প্রকাশভঙ্গি তৈরি করতে পারেন। ধরতে পারেন ভাষার লাগামও। মাই দাগেস্তান বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে এর প্রমাণ।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2013, 01:32 AM
Updated : 28 March 2013, 01:32 AM
 

রাসুল গামজাতভ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আভার কবি। তার আমলে মাত্র দু’লাখ লোক আভার ভাষায় কথা বলতো। সোভিয়েত আমলে রুশভাষায় রাসুলের কবিতার অনুবাদ রাসুলকে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি এনে দেয়। ভাষা একটা ইস্যু সন্দেহ নাই, কিন্তু তারও চেয়ে বড় ইস্যু কবির নিজস্বতা। যে ক’জন কবি এই নিজস্বতা গুণে জগতে এখনো প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছেন রাসুল তাদের অন্যতম। বইটি একজন কবির আত্মজীবনী হওয়া সত্বেও হয়ে উঠেছে খোদ দাগেস্তানেরই ইতিহাস। রাসুলই বলছেন ‘আমরা কবিরা সমগ্র পৃথিবীর নিকট দায়ী; কিন্তু যিনি নিজের জন্মভূমির প্রতি আসক্ত নন, তিনি সমগ্র গ্রহের প্রতিনিধি হতে পারেন না। তিনি সেই শ্রেণীর মানুষ যিনি স্বদেশ ত্যাগ করেছেন, অন্যত্র স্থায়ী হয়েছেন, অন্য দেশে বিবাহ করেছেন, শ্বাশুড়ীকে মা বলেছেন। শ্বাশুড়ীর বিরুদ্ধে আমার কিছু বলবার নাই, কিন্তু একমাত্র মাতা ব্যাতীত অন্য কেউ মা হতে পারে না।’

তিনি আরো বলেন ‘অদৃষ্ট আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক, আমি সর্বদা নিজেকে আমার মাটির, পর্বতরাজীর এবং যে গ্রামে আমি প্রথম ঘোড়ায় জিন লাগাতে শিখেছি, সেখানকার প্রতিনিধিরূপে অনুভব করি। যেখানেই থাকি, আমি নিজেকে আমার পটভূমি দাগেস্তানের বিশেষ সংবাদ-দাতা রূপে গণ্য করি।’

কবির দেশ মূলত কবির কবিতা। সেখানেই তিনি প্রবাহিত করে দেন নিজের দেশপ্রেম, স্বকীয় দর্শন, ও শ্রেণিচেতনা। কবির শ্রেণি মূলত একটা দেশের বা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ। তাদের সংস্কৃতি, সংস্কার, আচার। সে ক্ষেত্রে কবি কখনো একা নন। অনেক সাধারণের প্রতিনিধি তিনি। একেকটা সমাজের, একেকটা জাতি, রাষ্ট্রের। সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের ভেতরও নানান ভেদ আছে, শ্রেণি আছে। সমাজ ব্যাবস্থা যেভাবে গড়ে উঠে তাতেও শোষিত বঞ্চিত ও শোষকেরা বাস করে। দেখা যায় একটা সমাজে বেশিরভাগ মানুষেরাই নিরীহ, উচ্চবিত্তের দ্বারা শোষিত। তাহলে কবি কাদের গান গায়!

‘আমার প্রিয় তসাদা। পিতা যে বিশাল পৃথিবীর এতো ত্রুটি দেখেছিলেন, সেখান থেকে আমি তোমার কাছে আবার ফিরে এসেছি। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছি এবং আশ্চর্যান্বিত হওয়ার মতো অনেক কিছু দেখেছি। সৌর্ন্দযের প্রাচুর্য দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে, বিশেষ কোনো একটির উপর আমার দৃষ্টি স্থির-নিবদ্ধ হতে পারে নি। এক মন্দির থেকে অন্য একটিতে, এক মুখ থেকে অন্য একটিতে আমার দৃষ্টি পড়ছে; কিন্তু তবু আমি জেনেছি, এই মুহূর্তে যতো সুন্দর বস্তুই দেখি, পর দিন সুন্দরতর কিছু দেখতে পাব… …বুঝতে পারছ না, পৃথিবী যে সীমাহীন।

এ কি হতে পারে, যে দাগেস্তানের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম ভেনিস, কায়রো অথবা কলকাতা থেকেও সুন্দরতর? যে আভার স্ত্রীলোক মাথার উপর জ্বালানী কাঠের বোঝা নিয়ে পরিপার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছে সে কি স্ক্যান্ডিনেভিয়ানর দীর্ঘদেহী, সুকেশী নারী অপেক্ষাও লাবণ্যময়ী!’
এইখানে কবির জন্ম ও বেড়ে উঠার প্রশ্ন। রাসুল বেড়ে উঠেছিলেন তসাদার পাহাড়ী উপত্যাকায়। আভার গরীব স্ত্রীলোকদের তিনি জন্মাবধি দেখেছেন, মাথায় জ্বালানী কাঠের বোঝা নিয়ে পাহাড়ের গহীনতা থেকে ফিরতে। সেসবই তো গেঁথে থাকে কবির লিবিডোতে। এইসব জিনিস কবির আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে একসময় মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়।

মাই দাগেস্তান মূলত সোভিয়েত সাহিত্য সমিতি কর্তৃক ফরমায়েশ দেয়া লেখা। সাহিত্য সমিতি চেয়েছিল মূলত আভার সাহিত্য ও বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটা বই। কিন্তু রাসুলের মত কবির হাতে পড়ে সেটা হয়ে দাঁড়ায় রাসুল, আভার ও আভারের গণমানুষের জীবনী। শুধু রাসুল বা আভারের জীবনীই বা বলবো কেন? হয়ে উঠে বই জন্মেরও ইতিকথা। সাহিত্য সমিতির প্রস্তাবের সূত্রে ধরে রাসুল বলেন।

‘এক কালে মেয়েদের সম্মতি না নিয়েই তাদের বিয়ে দেয়া হত। আজকের ভাষায় (বিবাহ স্থির করা হয়েছে) এটা একটা বাস্তব ঘটনারূপে তাদের সম্মুখে উপস্থিত করা হত। তাকে বলা হত সব স্থির হয়ে গিয়েছে। অথচ, সেকালেও আমাদের এই পার্বত্য দেশে কেউ পুত্রের বিবাহ তার সম্মতি ব্যতীত স্থির করত না। লোকে বলে, গিদাতলির এক ব্যক্তি নাকি তা করেছিল। আমার শ্রদ্ধেয় সম্পাদকও কী পার্বত্য গ্রাম গিদাতলি থেকে এসেছেন? তিনি আমার জন্য সব ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু, আমি আমার দাগেস্তানের বৃত্তান্ত কুড়ি দিনের মধ্যে নয় পৃষ্ঠায় বলব বলে কী মনস্থির করেছি?’

 

এখনো সেই জিনিস দেখা যায়। অমুক বিষয়ের উপর এতদিনের ভেতর অত শব্দের একটা লেখা দিন। সম্পাদকদের গতবাধা প্রস্তাব। এবং সেসব লেখার বেতনভুক্ত লোকজনও রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত লেখা কি আদৌ ওভাবে হয়? লেখা একটা স্বতোস্ফুর্ত ব্যাপার। যাইহোক এটাও সত্য সে ফরমায়েশ না হলে হয়তো তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে এরকম একটা বই রাসুল লিখতেন কিনা সন্দেহ।

‘প্রিয় সম্পাদক, আপনার পত্রের অনুরোধ আমি পালন করব। শীঘ্রই দাগেস্তান সম্বন্ধে একটা বই লিখতে আরম্ভ করব। কিন্তু আপনার নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে না পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমাকে অনেক পথ চলতে হবে এবং আমাদের পার্বত্য দেশের পথ অত্যন্ত পেঁচানো ও খাড়া।’

খুব চমৎকার এক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন রাসুল। ব্যক্তিগতভাবে লেখক যে এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন বা বেড়ে উঠেন। তিনি সেই এলাকার আলোবাতাস, পারিপার্শিকতা থেকে লেখার গতি ও স্বভাব গ্রহণ করেন প্রায় নিজের অজান্তেই। এবং লেখক যা সবচেয়ে বেশি জানেন সেসবের উপমা, জানা শব্দের স্পন্দন লেখাকে সজীব করে তোলে। রাসুল বলেন,

‘ঈগল, কোথায় তুমি জন্মেছিলে?’
‘একটি সংকীর্ণ গিরিপথে।’
‘ঈগল, কোথায় তুমি উড়ে যাচ্ছ?’
‘বিরাট আকাশে।’

পুরা বইটায় এরকম অনেক লোককথা জড়ো করেছেন রাসুল। যা সেই সময় আভার এলাকাজুড়ে কথিত হতো। কিন্তু এসব কথার ভেতর রয়েছে অভিজ্ঞতার সারৎসার। উপরোক্ত পংক্তি কয়টি নির্ণয় করছে সংকীর্র্ণ এক গিরিপথেই জন্ম হয় কিন্তু তাকে বিকশিত হতে হয় বিরাট আকাশে। রাসুলও তাই। জন্মেছিলেন আভারের এক ছোট গ্রামে। কিন্তু তিনি আজ গোটা দুনিয়ার কবি।

রাসুল গামজাতভ জীবনে কবিতার ডানায় ভর করে গোটা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছিলেন। অনেক সম্মান পেয়েছিলেন তিনি সোভিয়েত সহ পৃথিবীর অনেক কবিতা সম্মেলনে। কিন্তু তিনি ফিরে গেছেন নিজের মাতৃভূমিতে। স্বভাষায় ছিলেন নিয়ত সৃজনশীল। গণমানুষ সবসময় তার কবিতা পাঠ করে আনন্দ পেয়েছেন। তিনি বলেন,
‘আমি এমন কবিতা এবং এই বইটাও এবং অন্য যা কিছু লিখি না কেন, সব যেন আমার স্নেহময়ী মা ও বোন, পাহাড়ের প্রত্যেকটি মানুষ ও অন্য যে কোনো পাঠকের বোধগম্য হয়।’

রাসুলের এই কথাটিই কবি হিসাবে রাসুলের শ্রেণিচেতনাকে উন্মোচিত করে। যে সত্যিকারের কবি কখনো দুর্বোধ্য হতে পারেন না।
বাংলাভাষায় ‘আধুনিকতা’ বলে একটা পর্ব আছে যার উত্থান হয়েছে তিরিশের দশকে। কিছু কলেজের ইংরাজি সাহিত্যের শিক্ষকদের হাতে। সেই হৃদয়হীন শিক্ষকেরা এক অদ্ভুত ভাষায় কবিতা লিখেছেন। আবহমান বাংলায় যা কিছু ঐতিহ্য ছিল সে সব কে প্রায় নাস্তানাবুদ করে হাজির করেছিলেন পাশ্চাত্য মিথলজি, সাহিত্যতত্ত্বের কচকচানি। যা এখনোব্দি শাসন করছে বাংলা কবিতা। তাদের সম্পর্কে রাসুল অসামান্য বলেছেন।

‘যখন সাহিত্য তার পিতৃপুরুষের খাদ্য থেকে পুষ্টিসাধিত না হয় এবং পরিবর্তে বিদেশী খাদ্য গ্রহণ করে, যখন সাহিত্য নিজের জনগণের প্রথা ও ঐহিত্য, ভাষা ও বৈশিষ্ট্যকে সম্মান করা বন্ধ করে এবং এগুলির প্রতি অবিশ্বাসী হয়, তখন সাহিত্য অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ক্ষয় হয়ে যায়। তখন কোনো ঔষধ সাহায্য করে না।’

হয়েছেও তাই বাংলা কবিতা এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যাকে সারানোর কোনো ঔষুধই পাওয়া যাচ্ছে না আর। যাইহোক লেখকদের জন্য অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ বইটি। যে কোনো বিষয়ে যখন একটা বই লেখা হবে। মানে লেখক যখন একটা বিষয়ে বই লিখবেন হতে পারে সেটা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, জীবনী। আসলে সাহিত্যের নৈতিকতাও হয়তো সেখানে যে, সেই বইটি হবে এতদিন ধরে এই ধারায় লিখিত সববইগুলোর চাইতে সেরা। সেই মাত্রায় পৌছানোর আগে যা তৈরি হয় সবই ভূসিমাল।

রাসুল বলেন ‘এই আমার বই। একে আমি মাকড়ি, ঘণ্টা অথবা অন্য কোনো সজ্জা দিয়ে সাজাতে চাই না। অন্য বইয়ের সঙ্গেও এটাকে তালগোল পাকাতে চাই না। আশা করি, পাঠকগণও তা করবেন না। আশা করি, এই বইয়ের মলাট নষ্ট হওয়ার পরও এটা যিনি পড়বেন, তিনিই বলবেন যে এই বই তসাদা গ্রামের গামজাতভের পুত্র রসুলে লেখা।’