চিনুয়া আচেবি : সবকিছু ভেঙে পড়ে

অবশেষে সেই দুঃখজনক সংবাদই ভেসে এল বিশ্ব মিডিয়ায়, আধুনিক আফ্রিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক চিনুয়া আচেবি আর নেই।

. কামরুল হাসানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2013, 02:02 AM
Updated : 24 March 2013, 07:27 AM

আমেরিকার বোস্টনের এক হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন নাইজেরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিশ্বসাহিত্যেরই এক শ্রদ্ধেয় মানুষ। সংবাদটি কেবল গোটা দুনিয়ায় তার অগণিত ভক্ত-পাঠকের জন্যই শোকের শেল নয়, এটা নোবেল কমিটির জন্যও শোকের; শোকের এবং একই সঙ্গে লজ্জার। চিনুয়া আচেবিকে সম্মানিত করার মধ্য দিয়ে নিজেদের সম্মানিত করার শেষ সুযোগটিও তারা এবছর হারালেন। মেধাবী লেখকদের এমাগত উপেক্ষা করে এবং তাদের স্থলে কম মেধাসম্পন্ন লেখকদের পুরস্কার দিয়ে ক্রমাগত বিতর্কিত হয়ে ওঠা নোবেল কমিটির ভূমিকা ও পুরস্কারপ্রদান আরো প্রশ্নবিদ্ধ হলো।

চিনুয়া আচেবির জন্ম আজ থেকে বিরাশি বছর আগে ১৯৩০ সালে নাইজেরিয়ার এক বৃহদাকার গ্রাম ওগিডিতে। নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের এঙ্গলিকান মিশনারিদের গোড়ার দিককার স্থাপিত গীর্জাসমূহের একটি ছিল এই গ্রামে। তাঁর বাবার চাচা ছিলের প্রভাবশালী এবং গোত্রপ্রধান। এখানেই আচেবের শৈশব কাটে এবং তিনি ইবাদানের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে ইংরেজীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময়কার শিক্ষায় পশ্চাৎপদ আফ্রিকায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেই একজন মানুষ সমাজের উচস্তরের বাসিন্দা বলে গণ্য হতেন, তাকে ভাবা হতো আলোকিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল ভেঙে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আফ্রিকার দেশগুলোতে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের বড়ই অভাব। প্রথম জীবনে রেডিও ঘিরে গড়ে ওঠা পেশাটির পরিসমাপ্তি ঘটে যখন ১৯৬৬ সালে জাতীয় জাগরণের উত্তাল দিনগুলোতে, যা পরিশেষে বায়াফ্রান যুদ্ধে গিয়ে গড়ায়, তিনি সহসাই চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বায়াফ্রার তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক ও তহবিল সংগ্রহের উদযোগে বায়াফ্রার প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সময়ে তাকে নাইজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ দেওয়া হয় এবং তিনি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পনের বছরেরও অধিক সময় ধরে তিনি বার্ড কলেজে চার্লন পি. স্টিভেনসন অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন। পরবর্তীতে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন আফ্রিকান সাহিত্য ও সংস্কৃতি।

যে উপন্যাস তাকে ভুবনজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তার নাম থিংস ফল এ্যাপার্ট (সবকিছু ভেঙে পড়ে)। বইটি ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে আর কমপক্ষে এর এক কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। এই বইটির জন্য তিনি ২০০৭ সালে ম্যানবুকার পুরস্কার লাভ করেন। এ উপন্যাস যখন লিখেন তখন আচেবি সাতাশ বছরের এক টগবগে যুবক, নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রযোজক হিসেবে কর্মরত। দু’বছরের একনিষ্ঠ লেখা ও নিরন্তর পরিমার্জনার পরে পান্ডুলিপিটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটেনের এক প্রকাশনা সংস্থায় যারা বিনামূল্যে তরুণ লেখকদের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ পান্ডুলিপি টাইপ করে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কিছুকাল ব্রিটেন থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তিনি গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন এবং ভয় পাচ্ছিলেন সম্ভবত তার অনেক শ্রমের ও মেধার ফসলটি হারিয়ে গেছে। পরে আচেবের এক পরিচিতজন ব্রিটেন থেকে টাইপকৃত পান্ডুলিপিটি উদ্ধার করেন এবং সেটি উইলিয়াম হেইনম্যান প্রকাশনী থেকে ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই উপন্যাসটি সাড়া ফেলে।

যে সম্প্রদায়ে আচেবের জন্ম সেই ইগবো সম্প্রদায়ের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘থিংস ফল এ্যাপার্ট’। উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে অকুনকো নামের এক সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও কুস্তিগীর, যার খ্যাতি পশ্চিম আফ্রিকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভুল করে সে যখন একজন অভিজাত শ্রেণির মানুষকে খুন করে ফেলে দৃশ্যপট পাল্টে যায় আর তার জগতের সবকিছু ভেঙে পড়তে শুরু করে। অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে অকুনকো দেখতে পায় তার গ্রামে মিশনারীর ধর্মযাজক থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসকদের প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছে তার শাস্তিবিধানে। অকুনকোর নির্মিত পৃথিবী ভারসাম্য হারিয়ে একবারেই উল্টে পড়ে আর নিয়তির অমোঘ দুর্দ্দশা থেকে তার আর পরিত্রাণ মেলে না, সে ধীর ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। একজন গর্বিত অথচ অসহায় মানুষের এই অনন্যগাঁথা যে মানুষ চোখের সমুখে তার জনগোষ্ঠির বিলয় প্রত্যক্ষ করে তারই শান্ত অথচ নির্মম, ভাবাবেগহীন ও বিদ্রুপাত্মক ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই একই সময়ে প্রকাশিত আফ্রিকার লেখকদের আরো দুটি উপন্যাস সাইপ্রিয়ান একওয়েনসির পিপল অব দ্য সিটি এবং এমোস টুটু্ওলার পাম-ওয়াইন ড্রিঙ্কার্ড এর চেয়ে থিংস ফল এ্যাপার্ট অনেক বেশি পরিণত ও সুসংবদ্ধ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটি একইসঙ্গে বর্বর ও নরোম, কৌতুকে উদ্ভাসিত এবং গভীর অনুভূতির মমতায় সিক্ত।

১৯৫৮ সালে থিংস ফল এ্যাপার্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় নো লঙ্গার এট ইজ (স্বস্তি নেই আর)। এ দু’টি বই আর ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় এ্যারো অব গড (দেবতার ধনুর্বান) নিয়ে গড়ে উঠেছে আচেবির ট্রিলজি - আফ্রিকান সাহিত্যের যা অন্যতম সেরা সম্পদ। থিংস ফল এ্যাপার্ট ম্যানবুকার পুরস্কার প্রদানের সময়ে আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ওলে সোয়েঙ্কা, যিনি পুরস্কারপ্রদান কমিটির একজন সদস্য ছিলেন, আচেবের এই উপন্যাস সম্পর্কে লিখেন ‘ইংরেজীতে এটিই প্রথম উপন্যাস যা একটি আফ্রিকান চরিত্রের অন্তঃস্থল থেকে কথা বলে, একজন সাদা মানুষের চোখে আফ্রিকার যে বর্ণিল চিত্র তা থেকে যা একেবারেই আলাদা’। এতদিন বহির্বিশ্ব যে আফ্রিকার ছবি উপন্যাসে বিধৃত হতে দেখেছে তা হল সাদা মানুষদের চোখ দিয়ে দেখা আফ্রিকা। এর আলোচিত উদাহরণটি ছিল কঙ্গোর প্রেক্ষাপটে রচিত জোসেফ কনরাডের বিখ্যাত উপন্যাস হার্ট অব ডার্কনেস। কনরাড তার লেখায় একজন শ্বেতাঙ্গ বহিরাগত হিসেবেই আফ্রিকার জঙ্গলে ‘সভ্যতার মৃত বিড়ালগুলো’কে খুঁজেছেন। আচেবের উপন্যাস আফ্রিকার হৃদয় থেকে, কালো মানুষদের চোখ দিয়ে দেখা শোষন ও বৈষম্যের আফ্রিকা, আফ্রিকার গোলযোগপূর্ণ রাজনীতি, উপনিবেশিক শাসকদের বিভিন্ন অপতৎপরতা ও কূটকৌশল এবং পশ্চিমা বিশ্বের চোখে আফ্রিকার যে ছবি - তা আচেবের লেখায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে, বিভিন্নভাবে বিধৃত হয়েছে।

কোয়ামে এন্থনি আপাইয়া আচেবিকে ইংরেজী ভাষায় আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের জনক বলে সম্বোধন করেছেন। আরেক নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক নদিন গর্ডিমার বলেন, তিনি এমন একজন লেখক যার কোনো বিভ্রান্তি নেই এবং তিনি নিজে বিভ্রান্ত নন, নিজেকে অনুকম্পা না করেই যিনি তার জনগণকে ভালোবাসেন, যিনি এক মহৎ, উদার প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। আলিস্টার নিভেন-এর মতে, আচেবি তাঁর লেখায় এতখানি মিতবাক আর ঘনসন্নিবদ্ধ বলেই জীবিত যে কোনো লেখকের চেয়ে আধুনিক আফ্রিকার কাহিনী অধিকতর, অধিক পারঙ্গমতায় বলতে পেরেছেন।

দীর্ঘজীবনে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র পঁচিশ। এতেই বোঝা যায় জনপ্রিয় ধারার ঠিক বিপরীতে আচেবের অবস্থান, বহুলপ্রজ নন তিনি, সস্তা কিছু কখনোই লেখেননি, দায়বদ্ধতা ছিল মহৎ সাহিত্যের প্রতি। এদের মাঝে যে কেবল উপন্যাস রয়েছে তা নয়, তিনি ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেছেন। অন্যান্য আলোচিত গ্রন্থের মাঝে রয়েছে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত কাব্য ‘ Beware, Soul Brother and Other Poems’, যা কমনওয়েলথ কবিতা পুরস্কার জিতে নেয়; ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত নির্বাচিত প্রবন্ধের সংকলন হোপস এন্ড ইমপেডিমেন্টস (আশা ও প্রতিবন্ধকতা)। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহ হচ্ছে এ ম্যান অব দ্য পিপল (১৯৬৬), সিভিল পিস (১৯৭১), এ্যান্টহিলস অব দ্য সাভানা (১৯৮৭), অ্যানাদার আফ্রিকা (১৯৯৮), হোম এন্ড এক্সাইল (২০০০)। এর মাঝে এ্যান্টহিলস অব দ্য সাভানা বুকার প্রাইজের সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠেছিল।

অসামান্য সাহিত্যসৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ চিনুয়া আচেবি তার জীবনে অসংখ্য সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মাঝে রয়েছে আমেরিকান একাডেমী অব আর্টস এন্ড লেটারসের সম্মানিত ফেলো, বুদ্ধিবৃত্তিক সাফল্যের জন্য নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মাননা। তবে ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ম্যানবুকার পুরস্কার তার সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি। ২০১০ সালে তিনি জরোথি আ্যান্ড লিলিয়ান গ্রিস পুরস্কার পান। সামরিক সরকার দু’বার তাকে নাইজেরিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক জাতীয় সম্মাননা ‘কমান্ডার অব দ্য ফেডারেল রিপাবলিক’ প্রদান করতে চাইলেও আজীবন ম্বৈরাচারী শাসকদের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আচেবে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। বিশ্বের ত্রিশটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে গৌরবান্বিত করেছে। এ সবই অসামান্য প্রতিভাবান এক সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি।

চিনুয়া আচেবির মৃত্যু একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাল, যে অধ্যায় দেখেছে কালো আফ্রিকার লেখকদের আধুনিক সাহিত্যের জগতে দর্পিত প্রবেশ ও সমীহজাগানিয়া পদচারণা। অন্ধকার মহাদেশ বলে পরিচিত আফ্রিকা সর্বদাই রহস্যঘেরা এক মহাদেশ যার সংখ্যাতীত নৃগোষ্ঠির আদিম জীবন-যাপন, আদিম সংস্কৃতি বহিঃস্থ পৃথিবীর অপার কৌতুহলের বিষয় হয়েছে। সে হিসেবে আফ্রিকার লেখকদের উপন্যাসের বিষয় এত আলাদা, তাদের সৃষ্ট চরিত্রসমূহের জগৎ এতটাই অচেনা যে বিষয়ের দিক থেকেই তারা অনন্য, এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় প্রকরণ ও শৈলীর মুন্সিয়ানা, আঙ্গিকের জাদুকরী বিন্যাস, তাহলে যা হতে পারে সেই মহৎ সাহিত্যই সৃষ্টি হচ্ছে আফ্রিকার প্রধান লেখকদের হাতে, চিনুয়া আচেবে যাদের মাঝে অগ্রগণ্য। তাঁর মৃত্যু বিশ্বসাহিত্যের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইনের পরিচালক সাইমন উইন্ডার বলেন, ‘আফ্রিকার সবচেয়ে বড় লেখক চিনুয়া আচেবির মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত।’ আমরা এই মহান সাহিত্যিকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কালজয়ী লেখায়, অগণিত পাঠকের মুগ্ধবিস্ময় আর পাঠের ঘোরের ভিতর।