মাতৃভাষার পক্ষে ওকালতি ও রবীন্দ্রনাথের ঢাকাসফর

রবীন্দ্রনাথ প্রথম ঢাকা এসেছিলেন মাতৃভাষার পক্ষে ওকালতি করতে। বিষয়টি কৌতূহল-উদ্দীপক, কেননা কাজটা রাজনৈতিক। সাহিত্য করাটা আশলে যে রাজনীতির বাইরের বিষয় নয়, তা অনুধাবনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা বা ঔদাসীন্য রবীন্দ্রনাথের ছিল না। যদিও তার ভক্তদের মধ্যে তাই লক্ষণীয়। এই যে মাতৃভাষার দাবি উত্থাপন, এর গুরুত্ব কবির কাছে এতখানিই যে, প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পর দ্বিতীয়বার ঢাকা এসে, প্রথম আগমনের স্মৃতিচারণ করছেন তিনি এভাবেই :

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 March 2013, 12:12 PM
Updated : 1 March 2013, 12:12 PM
বহুকাল পূর্বে আর একবার এই ঢাকা নগরীতে এসেছিলাম, সেদিনকার রাষ্ট্রীয় প্রাদেশিক সম্মিলনীর অধিবেশন উপলক্ষে। রাষ্ট্রীয় আন্দোলন ব্যাপারে নিপুণভাবে যোগ দিতে পারি এমন অভ্যাস ও শক্তি আমার ছিল না, এই অনুষ্ঠানে আমার দ্বারাও যে কাজ হতে পারে, আমি কেবলমাত্র তার ভার নিতে এসেছিলাম। তখনকার রাষ্ট্রীয় সভাগুলিতে ইংরেজি ভাষাতেই বক্তৃতা হ’ত। যাঁরা বাংলা ভাষার চর্চায় বিরত ছিলেন, যাঁরা এ-ভাষা সভাস্থলে ব্যবহার করতে জানতেন না, তাঁদেরই অনেকে রাষ্ট্রিক আন্দোলনের কাজে প্রাধান্য লাভ করেছিলেন। তার ফল হয়েছিল এই যে, জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রিক শিক্ষা বিস্তারের যে একটি মাত্র উদ্যোগ তখন ছিল, ইংরেজি ভাষার চাপে তার উদ্দেশ্যটি মারা গিয়েছিল। দেশের হিত কিসে হয়, তার বাধা কি, সে বাধা দূর করতে পারে কোন উপায়ে, দেশের লোককে সেই কথাটি ভালো করে ভাবিয়ে তোলাই দেশহিতের প্রথম ও প্রধান কাজ, কিন্তু এই ভাবনার চর্চা বন্ধ ছিল ইংরেজি জানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই। এই সংকীর্ণ বেষ্টনীর মধ্যে দেশসেবার যে সাধনা বিদেশী ভাষার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়েছিল, তাকে তার আপন ভাষার মধ্যে মুক্তি দেবার জন্যেই এখানে এসেছিলাম।
(ঢাকা করোনেশন পার্কে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে)

এ কথা বলা অসমীচীন হবে না যে, রবীন্দ্রনাথের এ উদ্যোগ, মাতৃভাষা বাংলার রাজনৈতিক দাবি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। সারা জীবনে তিনি মোট দুবার ঢাকা এসেছিলেন। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে, সরাসরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে, দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে, দার্শনিক মত প্রচারের অভিপ্রায়ে।


বৃটিশ-শাসিত ভারতীয় কেরানিকুলের কাকুতিমিনতি প্রকাশের প্লাটফর্ম হিশাবে যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম, তারই আয়োজনে অনুষ্ঠিত হতো প্রভিন্সিয়াল কনফারেন্স বা প্রাদেশিক সম্মিলনী। এবং এর একটা বাহ্যিক পরিচয় ছিল অরাজনৈতিক সংগঠন হিশেবে। বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণের সমস্যা ও চাহিদা নিয়ে পর্যালোচনা ও পরে তা কংগ্রেসের মূল অধিবেশনে উত্থাপন করাতেই এর কার্যসীমা ও কার্যপদ্ধতি। এতে অবাক হবার কিছু নেই যে, এসব ফোরামে নেতারা কথা বলতেন, বক্তৃতা করতেন ইংরেজিতে। কেননা, ইংরেজ প্রভুদের কাছে আর্তি প্রচার ও আর্জি পেশ করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সাধারণ মানুষের সমাগম উপলক্ষমাত্র। সে সাধারণের কাজ ছিল অনেকটা আড়ি পেতে শোনা ও বোঝার ভান করা। এর হাস্যকর ও অকার্যকর দিকটি লক্ষ করে প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথ সচেষ্ট হন বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে ও নেতাদের প্রভাবিত করতে। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন :

‘এ কনফারেন্স দেশকে মন্ত্রণা দিবার জন্য সমবেত, অথচ ইহার ভাষা বিদেশী। আমরা ইংরেজি শিক্ষিতকেই আমাদের নিকটের লোক বলিয়া জানিজ্জআপামর সাধারণকে আমাদের অন্তরে অন্তরে এক করিতে না পারিলে যে আমরা কেহই নহি, এ কথা কিছুতেই আমাদের মনে হয় না।… প্রভিনশ্যাল কনফারেন্সকে যদি আমরা যথার্থই দেশের মন্ত্রণার কার্যে নিযুক্ত করিতাম, তবে আমরা কী করিতাম? তাহা হইলে বিলাতী ধাঁচের একটা সভা না বানাইয়া দেশী ধরণের একটা মেলা করিতাম।… আমাদের যাহা কিছু বলিবার কথা আছে, তাহা ভদ্রাভদ্রে একত্রে মিলিয়া সহজে বাংলা ভাষায় আলোচনা করা যাইত।’

১৮৯৮ সালে ঢাকায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের দশম অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী ৩০শে ও ৩১শে মে এবং ১লা জুন। এই অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন কলকাতার রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপিনচন্দ্র পালও ছিলেন। সম্মেলনে আগত অতিথিদের থাকার জন্য অভ্যর্থনা সমিতি চারটি প্রাসাদোপম বাড়ি ঠিক করেছিলেন। বাড়িগুলো হলো জগন্নাথ কলেজ, পোগোস স্কুল, বুড়িগঙ্গার তীরে সাহেব পাড়ায় একটা বড় বাড়ি এবং কোর্টের কাছে আরেকটি। প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা কিছুটা বিলাতি কেতাদুরস্থ, মূলত তাদেরই জন্য নেয়া হয়েছিলো সাহেব পাড়ার বাড়ি। আর এই বাড়িতেই উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য গণ্যমান্য অতিথির সঙ্গে।

অধিবেশন হয়েছিল স্থানীয় ক্রাউন থিয়েটারে। প্রায় দুহাজার দর্শকের বসবার ব্যবস্থা হয়েছিল এ সভামণ্ডপে। ৩০শে মে সোমবার, বেলা দুটায় প্রথম দিনের অধিবেশন শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে। ‘আমায় বলো না গাহিতে বলো না’এই বিখ্যাত গানটি পরিবেশন করেন তিনি। যদিও এ গানে তথাকথিত দেশনায়কদের সমালোচনাই করা হয়েছে, তবু সকলেই গানটি শুনে মুগ্ধ হন। সভাপতি কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে অভিহিত করেন ‘সুইট সিঙ্গার অব ইজরায়েল’ বলে। দ্বিতীয় দিন সভা বসে বেলা সাড়ে বারটায়। এদিন সভায় রবীন্দ্রনাথ অংশগ্রহণ করেন মূলত প্লেগ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব, যা উত্থাপন করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজিতে, তার অনুবাদের মাধ্যমে। সভায় অনুবাদটি পাঠ করে শোনান তিনি। দ্বিতীয় দিনের সভার পর ঢাকা জেলার বিখ্যাত ভাগ্যকুলের রাজারা সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গা নদীর উপরে প্রতিনিধিদের জন্য আয়োজন করেন ভিন্নধর্মী এক স্টিমার পার্টি। আর শেষ দিন সভার পর রাত্রে অভ্যর্থনা সমিতি পার্টি দিয়েছিলেন ঢাকার নর্থব্রুক হলে।

সার্বিকভাবে এ আয়োজনের প্রশংসাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রসঙ্গকথা’ প্রবন্ধে। কিন্তু সম্মিলনে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুপস্থিতির সমালোচনা করতেও ছাড়েন নি :

ঢাকার লোকের যাহা কর্তব্য ছিল, তাঁহারা তাহার চূড়ান্ত করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। সে উৎসাহ, সে অনুরাগ, সে অধ্যবসায়ের কণিকা মাত্রেও ঢাকার মহোৎসব সুসম্পন্ন হইতে পারিত। ঢাকা কেন, সমগ্র পূর্ববঙ্গ উৎসাহে মাতোয়ারা হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবার একেবারে নিরুদ্যমে অবসন্ন।… বাঙ্গালীর উৎসাহ কি দুই দিনেই নিভিয়া গিয়া বহরমপুর কৃষ্ণনগর প্রভৃতি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সমিতির পুরাতন তীর্থক্ষেত্রে একমুষ্ঠি চিতাভস্মমাত্র পড়িয়া রহিয়াছে।… সমগ্র বঙ্গদেশকে এই সমিতি কতদূর একতাসূত্রে বাঁধিতে পারিয়াছে, তাহাই প্রত্যেক অধিবেশনের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কথা। সে হিসাবে ঢাকার অধিবেশন সফল হইয়াছে কি?


রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ঢাকা এলেন ১৯২৬ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, দর্শন বিভাগের প্রধান ড. হরিদাস ভট্টাচার্য, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ কবিকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন পি জে হার্ট্জ। আর রবীন্দ্রনাথ যখন ঢাকায় এলেন, ততদিনে মি. হাট্র্জ অবসর গ্রহণ করেছেন এবং নতুন উপাচার্য হিশেবে যোগদান করেছেন জি এইচ ল্যাংলি।

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকা আসছেন জেনে তখন শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও কবিকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে। এমনকি তাদের প্রতিনিধিরা শান্তিনিকেতন অব্দি গিয়ে কবির কাছ থেকে সে আমন্ত্রণ গ্রহণে সম্মতি আদায় করে আসে। এর ফলে গঠিত হলো রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা সমিতি। এর সভাপতি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা-বিচারক সারদা সেন, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ফণিভূষণ চক্রবর্তী, পরবর্তীকালে যিনি কলকাতা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা এসে কোথায় থাকবেন, এ নিয়েও একটা বাদানুবাদ হয়েছিল। সবশেষে সাব্যস্ত হয়, প্রথম তিনদিন তিনি বুড়িগঙ্গা নদীবক্ষে ঢাকার নবাবদের হাউসবোট ‘তুরাগ’-এ থাকবেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি হিশেবে উঠবেন অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে।

১৯২৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে ঢাকা মেলে রওয়ানা হন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ও তাদের পালিত কন্যা নন্দিনী, বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নেপালচন্দ্র রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীনিকেতনের কর্মসচিব কালীমোহন ঘোষ, শান্তিনিকেতনে কর্মরত ইতালীয় অধ্যাপক ফর্মিকি ও অধ্যাপক টুসি, ফরাসি ভাষা-প্রশিক্ষক ও কবির সেক্রেটারি মরিস ও শান্তিনিকেতনে চীনা ভবনের চীন দেশীয় অধ্যাপক লিম।

৭ই ফেব্রুয়ারি ভোরের দিকে তারা গোয়ালন্দে পৌঁছান। এখানে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল একটি বিশেষ স্টিমার। এই স্টিমারে করেই তারা সকাল ১১টার দিকে এসে পৌঁছেন নারায়ণগঞ্জ। অভ্যর্থনা সমিতির কর্তাব্যক্তিরা আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন নদী ঘাটে। এমনকি সাধারণ মানুষেরও বিপুল সমাগম ঘটেছিল। এখান থেকে ঢাকা যাওয়ার সহজ উপায় হলো ট্রেন। কিন্তু অভ্যর্থনা সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোটরকারে শোভাযাত্রাসহ তারা ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন। কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় তুরাগ হাউসবোটে।

কবিকে প্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয় ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি ও পিপলস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ঐদিন বিকাল ৪টায় নর্থব্রুক হল বা লাল কুঠিতে। রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় কবে কোথায় বক্তৃতা দেবেন, কোন কোন প্রতিষ্ঠান কবে তাকে সংবর্ধনা জানাবে, সেসব নিয়ে অভ্যর্থনা সমিতি একটা প্রোগ্রাম শিডিউল ছাপিয়েছিল ইংরেজিতে। যদিও এ শিডিউল ঠিক রাখা যায় নি। কারণ, ১০ তারিখে নানা অনুষ্ঠানে যোগদান করে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের হাত থেকে রেহাই পান নি। যেমন, ইডেন গার্লস কলেজের (বর্তমানে ইডেন মহিলা কলেজ) ছাত্রীরা তাদের লেডি প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে তুরাগ হাউবোটে এসেছিলো কবিকে প্রণাম জানাতে। আবার কর্মসূচির বাইরেও রবীন্দ্রনাথ তার পরিচিত-পরিজনদের বাড়ি গিয়েছেন। যেমন গিয়েছিলেন বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর বাড়ি। তার বাগান সম্বন্ধে কবি মন্তব্য করেছেন : ‘বাঙ্গালা দেশের অনেক স্থান আমি বেড়িয়েছি, কিন্তু নিজের বাড়িতে এমন সুন্দর বাগান তৈরি করে রাখতে ত কোথাও দেখি নি।’

রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় এসে যেসব বক্তৃতা করেছিলেন, তাতে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ভাষণ বা বক্তৃতা আমরা পাই। সেগুলির মধ্যে কার্জন হলে দুটি, প্রথমটি Meaning of art, দ্বিতীয়টি Rule of the giant। এছাড়া জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত দুটি ভাষণ।

এসব ভাষণে কবি মূলত তার সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতের সভ্যতা আত্মীয়তামূলক সভ্যতা। পুরাকালে সে ভারতের মন্ত্র ছিল : আয়ন্তু সর্বতঃ স্বাহা। অর্থাৎ সব জায়গা থেকে সবাই আসুক আমাদের কাছে। কিন্তু আজ ভারত তার সেই নিমন্ত্রণ নিজেই ভুলতে বসেছে। কবির মতে, অমৃৃতের পাত্র কখনো নিঃশেষিত হয় না। আজকের বিশ্বব্যাপী অশান্তির এই দিনে ভারতবর্ষই পারে বিশ্বকে আহ্বান করতে। বিশ্বভারতী সেই দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তার সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরেও যে আরেকটি কাজের ক্ষেত্র, সেদিকে দৃকপাত করার জন্য অভ্যর্থনাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন :

আমার বিশেষ একটা পরিচয় স্মরণ না রেখে আপনাদের উপায় নেই। বই বিস্তর লিখেছি, ছাপার কালিতে তার প্রমাণ রয়ে গেল। আমি সাহিত্য লিখে থাকি একথা গোপন নেই, কিন্তু সে ছাড়াও আরো কিছু পরিচয় বাকি ছিল। কাজের ক্ষেত্রেও নিজের বুদ্ধি-বিচার ও শক্তি অনুসারে দেশের সেবা কিছু করেছি। ভেবেছিলাম এই কথাটাই বুঝি আপনারা ভুলেছেন।

ভোলবার কারণ হিশেবে তিনি বলছেন, যেদিন নেতারা রাজদ্বারে দেশের কল্যাণের জন্য মিনতি জানাতেন, সেদিন তিনি এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, একপক্ষে কেবল প্রার্থনা, অন্যপক্ষে কেবল দাক্ষিণ্য, এর মাঝখানে যেটা ফাঁক, সেটা অসীম। সে আমাদের আত্মঅবমাননার প্রকাণ্ড গহ্বর। তার মতে, তখনকার উদ্যোগগুলি দুই অসমানের মিলনের সেতু নির্মাণের চেষ্টা। তিনি বলেছিলেন, অসাম্যের মিলন অসম্মানের মিলন। এসব বলার জন্য দেশহিতৈষীরা তাকে আখ্যায়িত করেছিল কর্মনাশা বলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঢাকাবাসীরা তার সে-সব কথা যে স্মরণে রেখেছেন, জেনে তিনি ধন্য।

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সম্পর্কে বলেন, শহরের প্রকাশ আমাদের দেশের প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। পূর্বকালে পূর্ববঙ্গের সমস্ত সভ্যতা শুধু এই একটি শহরে বিদ্যমান ছিল না। দেশের সর্বত্র পণ্ডিতেরা বিদ্যা, ধনীরা জল, সেবকেরা মন্দির অবাধে দিয়ে গিয়েছেন। আজকালকার দিনের মতো বিশেষ কোনো জায়গায় মিউসিপ্যালিটি করে সমস্ত শ্রী এক জায়গায় সংহত করা হতো না। তাই ঢাকার বিক্রমপুর প্রভৃতি স্থানে অনেক বড়ো পাণ্ডিত্যের বিকাশ হয়েছিল। এক ঢাকাতে নয়, সর্বত্র এবং সেটিই হচ্ছে বড় প্রকাশ, আত্মপ্রকাশ। তার মতে, এই অঞ্চলের মানুষের ভাষা যে প্রায় এক, তার কারণ হচ্ছে নদী। মাটির পথতার গতি নেই, জলের গতি নিজের গতি দ্বারা মানুষকে গতিবান করেছে। এই নদী যে শুধু পলিমাটি বহন করে নিয়ে এসে দেশকে উর্বর করেছে কিংবা শুধু স্তন্যধারা দিয়ে সরস করেছে, তা নয়, বরং তীর হতে তীরে, দূর হতে দূরে ঐক্য সাধন করেছে। সমস্ত দেশকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে শরীরের নাড়ির মতো এই নদী সমস্ত দেশে চৈতন্যধারাকে বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নদীর মতোই পরস্পর মিলনের আর একটি সূত্র হচ্ছে ভাষা। এর প্রভাব বাংলাদেশে যত, অন্য কোথাও তেমন নয়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি প্রদেশ অনেক বড়, কিন্তু সে দেশের ব্যবধান এত কঠিন যে, মানুষ তা সহজে অতিক্রম করতে পারে নি। তাই সেসব স্থানে এক প্রদেশেই বহু ভাষাভাষী জাতি।

আমরা জানি, নারী স¤পর্কে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমদিকে সংস্কারাচ্ছন্ন, সনাতনী হলেও শেষের দিকে এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছিল। তার সেই প্রগতিশীল চিন্তার আভাস ফুটে ওঠে ঢাকার মহিলাদের সংগঠন দীপালি সংঘে প্রদত্ত ভাষণে। সে ভাষণের এক জায়গায় তিনি বলছেন :

কালে কালে অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে কর্মক্ষেত্রে নব নব পরিণতি সাধন করতেই হয়। তখন পুরাতন অভ্যাসের জায়গায় নতুন উৎসাহের দরকার হয়। নূতন যুগের আহ্বান উপস্থিত হলে তবু যারা অপরিচিত পথের দুর্গমতা এড়িয়ে পুরাতন কালের কোটরে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকতে চায়, মৃত্যুর চেয়েও তাদের বড়ো শাস্তিতাদের শাস্তি জীবনমৃত্যু।

বুড়িগঙ্গা নদীতীরের জনাকীর্ণ এলাকা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ রমনায় রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে আসেন ১০ই ফেব্রুয়ারি। এদিকটায় জনবসতি তেমন ছিল না। গাড়ি থেকে নেমেই তাই মন্তব্য করেছিলেন, যে জায়গা থেকে এলাম ও জায়গাটা ঢাকা, আর তোমার এখানটা ফাঁকা। এ বাড়িতে অবস্থানকালেই জগন্নাথ হলের ছাত্ররা কবিকে এসে অনুরোধ করেন তাদের ‘বাসন্তিকা’ পত্রিকার জন্য একটি কবিতা লিখে দিতে। রবীন্দ্রনাথ তাদের লিখে দিয়েছিলেন ‘বাসন্তিকা’ নামে সেই কবিতাটি, যা পরবতী কালে গান হিশেবে বহুখ্যাত ও পরিচিত হয়ে ওঠে : এই কথাটি মনে রেখো, / তোমাদের এই হাসিখেলায় / আমি যে গান গেয়েছিলেম / জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।…
কবিতাটি লিখেছিলেন ৩রা ফাল্গুন, ১৩৩২ অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬। তার ঢাকাবাসের শেষ দিন। এই দিন বেলা সাড়ে এগারোটায় তিনি ট্রেনে সদলে ময়মনসিংহ রওয়ানা হন এবং সেখানে মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদার মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ময়মনসিংহে পৌঁছে পরদিন রমেশ মজুমদারের স্ত্রীকে কবি টেলিগ্রাম করেন :
Mrs. Ramesh Majumder
Dhaka, Ramna

Many thanks for hospitality and kindness.
Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথের এই সৌজন্য-সামাজিকতার প্রসঙ্গটি রেখে পরিশেষে আমরা আবার উল্লেখ করতে চাই সেই প্রথম দিনের কথা। প্রথম দিন ঢাকায় এসে বুড়িগঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত করোনেশন পার্কে দাঁড়িয়ে তিনি যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, তাতেই জানা যায় তার এই ঢাকা সফরের মূল উদ্দেশ্যটি। বেশ আবেগজড়িত কণ্ঠেই কবি উচ্চারণ করেছিলেন :

পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পূর্বে বঙ্গদেশের দিকে দিকে চৈতন্যকে পরিব্যাপ্ত করব, আপনাদের সঙ্গে প্রীতি-সম্মিলন উপলক্ষে বঙ্গদেশের বিচিত্র পীঠস্থানে অধিষ্ঠিতা বঙ্গলক্ষ্মীর কাছে প্রীতি-অর্ঘ্য নিবেদন করে দিয়ে যাবো, এইবার এইটুকু মাত্র আমার আশা। আজ জীবন-পথ যাত্রার শেষ প্রান্তে পৌঁচেছি। মাতৃভূমির সকল তীর্থ হতেই বঙ্গজননীর শেষ চরণধূলি নিয়ে যাবো, সেই প্রত্যাশায় এখানে আমার আসা। আপনারা আমার প্রতি অনুকূল হোন। সমস্ত জীবনে দেশের কাছে আমার যা উৎসর্গ করেছি, সেই নৈবেদ্য থেকে নির্মাল্য নিয়ে প্রসন্ন মনে যদি বলতে পারেন, ‘এ রইল, এ রাখলুম, আমাদের ভাষার মধ্যে, আমাদের সাহিত্যের মধ্যে, আমাদের কর্মসংকল্পের মধ্যে’তা হলেই আমার চরিতার্থতা। মনে রাখবেন, আপনাদের কবি একদিন এই সুন্দর সূর্যাস্তকালে এই সুন্দর নদীতীরে আপনাদের সকলের মধ্যে হৃদয় প্রসারিত করেছিল। এই মনোহর সন্ধ্যার আলোকে আলিঙ্গিত কবির চিত্রকেই স্মৃতিপটে রেখে দেবেন। কেননা, এই মর্ত্যকবিরও অস্তের দিন কাছে এসেছে, পশ্চিম সূর্য ঐ যে তার জ্যোতি-রশ্মির অঙ্গুলি সংকেতে আমাকে অস্তাচলের পথ নির্দেশ করচে। তাই আজ ঐ সন্ধ্যাসূর্যের শেষ বাণীর দ্বারাই আমার বিদায় অভিবাদনকে পূর্ণ করে আপনাদের কাছে রেখে দিয়ে গেলাম।