একুশ শতকে একুশের চেতনা

দীর্ঘপথ পেরিয়েও ‘বায়ান্নের একুশ’ এখনো জ্বলজ্বলে আমাদের চেতনায়। এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন, ভাষাআন্দোলনের প্রজন্ম থেকে এই সময় পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন প্রজন্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রের একুশজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিমত নিয়ে এবারের অমর একুশে ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই লেখাটি তৈরি করেছেন রাশেদ শাওন।

রাশেদ শাওনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2013, 01:38 AM
Updated : 21 Feb 2013, 01:38 AM
‘শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় কথা বলবো এবং নির্ভুল বাংলা লিখবো’

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক
বায়ান্ন সালে রাজপথে দাঁড়িয়ে যে দাবী জানিয়েছিলাম এখনো দাবী অনেকটা তাই। প্রথমত শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, যেমন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জীবিকা ও কর্মক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চত করতে হবে, যাতে বর্তমান প্রজন্ম অন্য ভাষার দিকে ঝুঁকে না যায়। বিভিন্ন মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে এক ধরণের বিকৃত বাংলায় কথা বলছে, এটা বন্ধ হতে হবে। আমরা বাঙালিরা শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় কথা বলবো এবং নির্ভুল বাংলা লিখবো, এটাই প্রত্যাশা।

‘একুশ ফিরে ফিরে আসবে বারবার’

সৈয়দ শামসুল হক: সব্যসাচী লেখক
একবিংশ শতাব্দী এসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি একুশের চেতনাকে। আমাদের সামনে উদাহরণ হলো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। এখানে তারুণ্যের স্ফূরণের মাধ্যমে যে ইতিহাসের চেতনা দেখা যাচ্ছে এটাই তো আমাদের ভাষার চেতনা। কালে কালে এই চেতনা অটুট থাকবে। আর একুশ ফিরে ফিরে আসবে বারবার।

‘শাহবাগ আন্দোলন সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর-এর মতই নতুন আঙ্গিকের প্রকাশ’

শামসুজ্জামান খান: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের আধুনিক রূপ। তরুণ সমাজ এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক সমাজব্যবস্থা ও আধুনিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই শাহবাগ আন্দোলন সাতচল্লিশ, বায়ান্ন, একাত্তর এর মতই নতুন আঙ্গিকের প্রকাশ। এবং সেটাই হবে এবারের একুশের মূল চেতনা।

‘জেগে উঠুক আমাদের ভাষা প্রেম’

হায়াৎ মামুদ: কবি-গবেষক-শিক্ষাবিদ
প্রথম কথা হচ্ছে ফেব্রুয়ারি মাস পার হলেই আমরা একুশের কথা ভুলে যাই। এটা আমাদের রুটিন কাজের মতই হয়ে গেছে। এরপরের বাকি এগারো মাস বাংলা ঠিক ভাবে বলিওনা। শুদ্ধভাবে লিখতে পর্যন্ত পারি না। কেউ খেয়ালও রাখি না বাংলার সঙ্গে ইংরেজী মিলেমিশে যাচ্ছে। এটা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য সবচেয়ে লজ্জার বিষয়। রক্তের বিনিময়ে যে ভাষা পেয়েছি, সেই ভাষার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা থাকা উচিত। এই ভাষার প্রতি আমাদের অবহেলা এবং অসচেতনার কারণে আমরা অনেকেই বাংলাকে শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারি না। এবারের একুশের চেতনা হোক এই বিচ্যুতি থেকে উত্তরণ। আমরা সচেতন হই। এবং মাকে আর দেশকে যেমন করে ভালোবাসি, ভাষাকেও তেমন করে ভালোবাসতে শিখি। জেগে উঠুক আমাদের ভাষা প্রেম।

‘একুশের চেতনা ছিলো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর’

হাসনাত আবদুল হাই: কথাসাহিত্যিক

এবারের একুশের চেতনা হবে জীবনের প্রত্যেক স্তরে সারা বছরই বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির যারা আছেন তাদের মাতৃভাষা রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া। একুশের চেতনা ছিলো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর। এর ধারাবাহিকতায়-ই আমাদের জীবন যাপনকে বিন্যস্ত করতে হবে।

‘বাংলা একটি অত্যন্ত প্রবল ভাষা’

ড. করুণাময় গোস্বামী: গবেষক-সঙ্গীতবিদ
একবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা বিশ্বসভায় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য স্থান পাবে আমরা ধারণা। বাংলা পৃথিবীর ষষ্ঠ ব্যাপক ভাষা। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য এরই মধ্যে নানা দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক দাবী ওঠেছে। বাংলাভাষার প্রকাশ ক্ষমতাও অসামান্য। সংশয় ছিলো তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা হিসেবে বাংলা তার স্থান করে নিতে পারবে কিনা। সেই সংশয়ও এখন কেটে যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, কি সাহিত্যে ভাষা, কি আইনের ভাষা হিসেবে, কি দপ্তর পরিচালনার ভাষা হিসেবে, কি প্রযুক্তি বান্ধব হবার ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাভাষার কোন দুর্বলতা নেই। একুশের চেতনার কথা যদি বলি, সে হচ্ছে সর্বস্তরে সকলমাত্রায় বাংলার প্রয়োগ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যাচ্ছে সকল ক্ষেত্রেই বাংলা একটি অত্যন্ত প্রবল ভাষা। ফলে আমাদের অত্যন্ত আনন্দ যে, বাংলাভাষা পৃথিবীর অন্য পাঁচটি বৃহৎ ভাষার মতই আপন স্থানে গৌরবের সঙ্গে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে।

‘সৃষ্টিশীল বাঙালি একুশ শতকে সুনীতিশীল হোক’

মুহম্মদ নূরুল হুদা: কবি-প্রাবন্ধিক
যতদিন বাংলা ভাষা, ততদিন এই বাংলাদেশ। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ একই সূত্রে বাঁধা। আজ বাঙালি বিশ্ববাঙালি, আর বাংলাভাষাও এক বিশ্ব ভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে চলেছে। একুশের চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর বিপন্ন ও লুপ্ত মাতৃভাষাগুলোও সজীব হতে চলেছে। ব্যাপ্ত হচ্ছে ভাষাবাহিত মানববৈচিত্র্য।
তারই পাশপাশি আবহমান কালের সৃষ্টিশীল বাঙালি একুশ শতকে একুশের বিবর্তমান চেতনায় অঙ্গীকৃত হয়ে মুক্তমানবিক ও পরিপূর্ণ সুনীতিশীল হয়ে উঠুক। একুশ শতকে একুশ হোক বিশ্বব্যাপী আমাদের চিরনবায়নপ্রবণ পথ চলার শক্তি।

 

‘একদিন এই ভাষা হয়ে উঠবে সব কাজের উপযোগী’

খোন্দকার সিরাজুল হক:শিক্ষাবিদ-গবেষক
একবিংশ শতাব্দী দাঁড়িয়েও একুশ এখনো প্রাসঙ্গীক। একুশের চেতনা জাগ্রত আঝে বলেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এই চেতনা থেকে যখনই আমরা পিছিয়ে গেছি তখনি জাতি হিসেবেও আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। একুশকে ধারণ করে আমরা দ্বান্দ্বিক নিয়মে এগেয়ি চলছি। এবারের আমরা দেখলাম শাহবাগ জেগে ওঠেছে। এই জাগরণ প্রমাণ করে একুশের চেতনা এই প্রজন্মের মধ্যে বিস্তৃত। আর এই বিস্তৃতি আছে বলেই এজাতি বছরের পর বছর এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। আমাদের ভাষা সাহিত্য নিয়ে নানা ধরণের দ্বন্দ্ব আছে সেটা কেটে যাবে। বাংলা ভাষা নিয়েও এক ধরণের হীনমন্যতা আছে। এটাও দূর হবে ভবিষ্যতে। একদিন এই ভাষা হয়ে উঠবে সব কাজের উপযোগী।

‘একুশের ক্ষেত্রে নতুন পুরোনো বলে কোন কথা নেই’

সুব্রত বড়ুয়া: কথাসাহিত্যিক-বিজ্ঞান লেখক
সময় পরিবর্তিত হয়। জীবনেও পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এখনো একুশের চেতনা অক্ষয় আছে। তবে জীবন নানা রকমমের সমস্যা আছে। সেই সমস্যাগুলোর ভিতরেই একুশের চেতনা সবসময় রয়ে গেছে বাঙালির জীবনে। যখন একুশ এসেছিলো তখন এটি শুধুই রাষ্ট্রভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার দাবী ছিলো। সেই দাবী এখন আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। একুশের ক্ষেত্রে নতুন পুরোনো বলে কোন কথা নেই। এটি সব সময় আমাদের চেতনায় জাগ্রত।

‘সারা বিশ্বে আমাদের পদচারণা দেখা যাবে’

নাসির উদ্দীন ইউসুফ : নির্মাতা-নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক
একুশ শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একুশ বৃহত্তর অর্থে সংস্কৃতিক আন্দোলন, আর্থ-সামাজিক আন্দোলন আর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলো। আজো সেই পথেই আমরা হাঁটছি। আজো তাই মানুষের জীবনে একুশ বারবার ফিরে ফিরে আসে। নতুন দিকের সন্ধান দেয়। এই একুশ সারা পৃথিবীর মানুষের সবার নিজ নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারের প্রতীক। এর ফলেই সকল মানুষ নিজ নিজ ভাষায় তার প্রয়োজনের কথা, দাবী, মত প্রকাশ করতে পারছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে একুশকে আমরা নানা ভাবে বিন্যস্ত হতে দেখবো। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে আমরা আমাদের ভাষাকে জড়িয়ে দিতে পারি, তবে বাঙালির এই ভাষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে সারা বিশ্বে আমাদের পদচারণা দেখা যাবে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাবে বাংলা এবং একুশের চেতনা।

‘একুশের রোপিত অংকুর বিশাল মহীরুহে পরিণত হবে আগামীতে’

সানউল হক খান: কবি
আজকের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিলো বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে। ’৪৮-এ যখন পাকিস্তানী জান্তা ঘোষণা করেছিলো ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ তখন থেকে এই আন্দোলনের সূচনা। তখন জাতীয়তাবাদী মানুষ ধরেই নিয়েছিলো এদের সঙ্গে থাকা যাবে না। এরপর একে একে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয়দফা, ’৬৯-র গণআন্দোলন, ’৭০ সালের নির্বাচন, সবশেষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধ। এসবই আমাদের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার একেকটি সোপান। এই সিড়িগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে শিকলের মত বাঁধা। এই শিকল এ প্রজন্মের কেও যেন না ছাড়ে। সেই শিকলটা এখন ষোল কোটি মানুষকে নিয়ে ব্যাপক আকারে বিস্তৃত।
তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। নিজেদের ঘরের ভিতরেই রয়েছে শত্রু। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ভাবে এখনো অনেক সংগঠিত। এরা এখনো এদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীনতা মানতে অনেকে গররাজি, কেউ নিমরাজি আবার, কেউ কেউ তো বিদ্রোহী। আমাদের চলার পথে কোথাও না কোথাও ভুল ছিলো। সেই ভুলের পথ ধরে আজো তারা সক্রিয়। এই প্রজন্ম তার বড় সাক্ষী। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের জ্বলে-ওঠা তাদের একুশের চেতনার বর্হিপ্রকাশ। এটা একুশেরই ফসল।
আমি এই প্রজন্মকে বলবো ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চলবে না। তাদের প্রলুব্ধ হওয়া যাবে না। আমাদের ভুলকে শুধরে আগামীর জন্য সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণের চিন্তা করতে হবে। আর একুশের রোপিত অংকুর বিশাল মহিরুহে পরিণত হবে আগামীতে।

‘এই প্রজন্ম কিন্তু বাংলাকে ভুলে যায়নি’

মামুনুর রশিদ: নাট্যনির্দেশক-নাট্যকার-কলাম লেখক
একটা সময় ছিলো যখন প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া বা গণমাধ্যম ছিলো না। তখন সময়টা ছিলো এক ধরণের। গুটি কয়েক মানুষ এসব নিয়ে ভাবতো। এখন নানা ভাবে এই বিষয়টি বিকোশিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সারা বিশ্বে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমি প্রবাসীদের কথা বলছি। তাদের ভিতরে এই চেতনাটা দারুণ ভাবে সঞ্চারিত হয়েছে। এখন অসংখ্য বাঙালিরা দেশে আসে ফেব্রুয়ারি মাসে। তারা একুশকে উদযাপন করতেই এ সময় আসে। তারা সারা বছর নিজের ভাষায় কথা বলতে পারে না। তাই তাদের ভিতরে এই আকুতিটিও থাকে প্রবল।
আমাদের চারপাশে এখন অনেক প্রাইভেট স্কুল কলেজ। যেখানে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। তা হলে কি হবে, এই বাচ্চারাই কিন্তু একুশের কথা জানছে ইংরেজিতে। ফলে তারাও বাংলাকে জানছে কোন না কোন ভাবে। তারপরেও এই প্রজন্ম কিন্তু বাংলাকে ভুলে যায়নি। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর তার প্রমাণ। যতদিন বাংলাদেশ ও বাংলাভাষা থাকবে ততদিন এই চেতনা থাকবে।

‘ভাষার মূল শ্রোত ঠিকই বয়ে যাবে’

ইমদাদুল হক মিলন : কথাসাহিত্যিক
একুশের চেতনার নবরূপ বলে কিছু নেই। যতদিন বাঙালি জাতি আছে ততদিন একুশের চেতনা টিকে থাকবে। ভাষার চেতনা কখনো ম্লান হয় না। কখনো ম্লান হবার নয়। সময়ের সাথে সাথে ভাষার চেতনাবোধ বদলাতে পারে। কিন্তু ভাষার মূল স্রোত ঠিকই বয়ে যাবে।

‘শেকড়কে ঠিক রেখে আমরাও সামনে এগিয়ে যাবো’

আখতার হোসেন : শিশুসাহিত্যিক
এক শতাব্দীতে চারটি প্রজন্ম ধরা হয়। সেই হিসেবে এখন আমরা এই শতকের প্রথম প্রজন্মকে প্রত্যক্ষ করছি। সময় পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রজন্মের চিন্তা, চেতনায় পরিবর্তন আসে। আর পৃথিবীতে এখন রাজত্ব করছে ইন্টারনেট। এখন ই-মেইল আছে, ই-বুক হয়েছে। ভবিষ্যতে বইয়ের জায়গা দখল করে নেবে ই-বুক। তবে আমাদের রয়েছে ভাষাআন্দোলনের মত অধ্যায়। আমাদের ভাষায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মত লেখক। আমাদের আর কি চাই। পৃথিবীর কোন জাতিই সময়ের পরিবর্তনের সাথে তার গৌরব ও ঐতিহ্যকে ঝেড়ে ফেলে না। আমরাও পারবো না। তবে পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। আমাদের শেকড়কে ঠিক রেখে আমরাও সামনে এগিয়ে যাবো।

‘সব ভাষার প্রতি সমান সম্মান দেখানো উচিত’

আনিসুল হক: কথাসাহিত্যিক
একবিংশ শতাব্দীতে একুশের মূল চেতনার একটি বিষয় হচ্ছে গণতন্ত্র। ভাষা আন্দোলনের সময় আমাদের দাবীটিও ছিলো নায্য এবং গণতান্ত্রিক। কারণ তখন আমরা বলি নাই বাংলাই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা বলেছিলাম বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। এখনো এই কথাটিই বলবো। আমাদেরও সব ভাষার প্রতি সমান সম্মান দেখানো উচিত। কারণ সব ভাষাই মূল্যবান।
এখনতো প্রযুক্তির কল্যাণে সবকিছুই বুড়ো আঙ্গুলের নখের ডগায় পাওয়া যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যে ভাষার কল্যাণে মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভোবান হতে পারছে, তারা সেই ভাষার দিকেই ঝুঁকে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেও আমি শংকিত নই। কারণ এখনো এদেশের পঁচানব্বই ভাগ ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করছে। বাংলা এখন আর্ন্তাজাতিক মাতৃভাষার প্রতীক। এই ভাষার মান তারা অবশ্যই বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবে।

‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এলে ভাষারও মুক্তি মিলবে’

বিশ্বজিৎ ঘোষ: ভাষাবিজ্ঞানী
আমাদের একুশের চেতনার ফসল আজ বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃত। এখন একুশ মানে এটা আর্ন্তজাতিকভাবে মর্যাদা পেয়েছে। তবে দেশে দেশে মাতৃভাষা এখনো পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা পায়নি। এটা একধরণের ব্যর্থতা। প্রতিদিনই প্রায় তিনটি করে মাতৃভাষা মরে যাচ্ছে। এখনো সব মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য উদ্যোগ না নিলে আগামী পঞ্চাশ বছরে সাড়ে তিন হাজার মাতৃভাষা মরে যাবে। আমরা প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি এলেই মাতৃভাষা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ফেব্রুয়রি চলে গেলে আর কোন উচ্চবাচ্য হয়না। এটা খুবই দুঃখজনক।
আর একটা বিষয় হল প্রতিটি দেশের মাতৃভাষা সেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি মনে করি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব দেশরই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এলে ভাষারও মুক্তি মিলবে। তাহলে একুশের যে চেতনা তা এই একুশ শতকে এসেও অক্ষুন্ন থাকবে। আর তার চাওয়ারও বাস্তবায়ন হবে।

‘নতুন প্রজন্ম ভাষাকে আরো বেশি ভালোবাসবে’

লুৎফর রহমান রিটন: শিশুসাহিত্যিক
একজন লেখক হিসেবে আমি মনে করি একবিংশ শতাব্দীর নবরূপ হচ্ছে ভাষার প্রতি আমাদের বিপুল ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশটাই একটি ভাষাভিত্তিক দেশ। আমরা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন করে ভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছি। তারপরে সেই পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যেসব বাংলাভাষায় লেখালেখি করেন বা আমি যেমন ছোটদের জন্য লিখি, আমি মনে করি, একবিংশ শতাব্দীতে আমার দায়িত্ব হচ্ছে শিশুদের কাছে আমার ভাষার প্রতি যে মমত্ববোধ সেই মমতাটা শিশুদের মধ্যে সঞ্চারিত করা। ছোট্ট শিশুটি যেন বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করবে, কথা বলার ক্ষেত্রে বা লেখার ক্ষেত্রে, সে যেনো সঠিক এবং শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষাটিকে ব্যবহার করে। বাংলাভাষাকে সঠিক ভাবে বাংলাভাষা সঠিক ভাবে উচ্চারণ করাটাও কিন্তু ভাষার প্রতি দায়িত্ব পালন করা হয়। আর আমার প্রত্যাশার জায়গাটা হচ্ছে নতুন প্রজন্ম ভাষাকে আরো বেশি ভালোবাসবে। তারা বিভিন্ন ভাষার আগ্রাসনকে প্রতিহত করবে। এবং সবার উপরে তারা মাতৃভাষাকে মর্যাদা দিবে। অন্য ভাষা তারা অবশ্যই শিখবে। এখন বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর নানা ভাষা তাকে শিখতে হতে পারে। এবং শিখতেই হবে তাকে টিকে থাকতে হলে। কারণ সে প্রতিযোগিতামূলক একটি বিশ্বের নাগরিক হবে। কিন্তু সে যেন মাতৃভাষার মর্যাদা সারাজীবন রক্ষা করে এবং মায়ের ভাষাকে সবার উপরে স্থান দেয়।

‘একুশের মূল শক্তি মাটি, মানুষ, ভাষা ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা’

ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী: সমালোচক-গবেষক
একুশ আমাদের চেতনার মূল সুত্র। একুশকে কেন্দ্র করেই এদেশের মাটি-মানুষের সংযোগ ও নৈকট্য গড়ে উঠেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ফিরে যাচ্ছি বৃহৎ বিশ্বের কাছে। বিশ্বও এখন আমাদের ঘরের ভিতরে। একে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সবাইকে বিশ্বের নাগরিক হতে হবে। একুশের চেতনা ছাড়া এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। একুশের চেতনার মূল শক্তি মাটি, মানুষ, ভাষা ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা। এদেশের মানুষের এটা অক্ষুন্ন থাকলেই এদেশের অগ্রগতি হতে বাধ্য।

 

‘একুশ স্বরূপে বারবার আসবে তারুণ্যের জয়গান গাইতে গাইতে’

নাসরিন জাহান: কথাসাহিত্যিক
আমার বেড়ে ওঠার সময় থেকেই শুনে এসেছি আমাদের ভাষা, একুশের সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এসব হারিয়ে যাবে। কিন্তু এখন সময় বলছে উল্টো কথা। এসবের কিছুই হারায়নি। বরং আমরা এসবের মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করছি। আমি আশাবাদী মানুষ। এখন বইমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারি বা অন্যকোন জাতীয় দিন নিয়ে প্রজন্মের মধ্যে যে ধরণের আবেগ দেখি তা থেকে বলতে পারি, একুশের চেতনা আরো প্রবলভাবে আমাদের প্রভাবতি করছে। আজকে শাহবাগে প্রজন্মের যে জাগরণ তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে কিছুই শোনেনি পর্যন্ত। কিন্তু নিজেদের বোধ তাদের এই জায়গায় টেনে এনেছে। সুতরাং যতদিন যাবে, প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাবে আমাদের চেতনার জায়গাটিও ততটাই দৃঢ় হবে। একুশ তার স্বরূপে বারবার আসবে তারুণ্যের জয়গান গাইতে গাইতে।

‘আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আরো উচ্চতর দিকে যাবে’

হরিশংকর জলদাস: কথাসাহিত্যিক
একুশ আমাদের সংস্কৃতিতে, মননে, গড়নে ক্রিয়াশীল। আমি মনে করি আমাদের বাঙালির অগ্রযাত্রায় একুশ ছিলো প্রথম সোপান। এই সোপানে পা দিয়ে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পথ চলছি। আর শতাব্দীর পর শতাব্দীতে আমাদের অগ্রযাত্রায় এটার মর্যাদা, একুশের আবেদন কখনো ক্ষুণ্ন হবে না।
আমি মনে করি ভবিষ্যতে এদেশে আরো অগ্রসরমান, সংস্কৃতিমনা, উন্নত মানুষ আসবেন। তাদের কাছেও একুশের মর্যাদা থাকবে অটুট। আমাদের স্বাধীনতা ও বোধে যদি না কখনো অন্ধকার নামে, এই চেতনাও কখনো হারাবে না। এই চেতনাকে ধারণ করেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আরো উচ্চতর দিকে যাবে।

‘লেখালেখি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চা, শিল্পচর্চা ইত্যাদি নানা মাধ্যমে অনেক কিছুই করার আছে’

মাসুদুজ্জামান: কবি- প্রাবন্ধিক
আমি মনেকরি, এখনকার তরুণ প্রজন্ম আগের চাইতে অনেক বেশি সচেতন। তারা মুক্তবুদ্ধির চেতনার মানুষ। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেককিছু পেতে পারি এবং পাবো। আমি আরো মনে করি আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনেক কাজ করার আছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কেন্দ্র করে যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সেই রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য লেখালেখি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চা, শিল্পচর্চা মাধ্যমে অনেক কিছুই করার আছে। তা যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা পেতে পারি এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুব স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবে। শাহবাগ চত্বরের তরুণরা সেই চেতনার সূচনা ঘটিয়েছে। এই সময়ে এসে সেটাই বড় আশার কথা।
(এই লেখাটি তৈরি করতে সহায়তা করেছেন সুমাইয়া রাশেদ বিদুর।)