পুতুলগাছ

নূরুল আলম আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2013, 10:23 AM
Updated : 19 Jan 2013, 10:23 AM

কথা কথা কথা…

‘ভয় পাবার অ্যাকটিংটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছিস!’ ওশো’র একটা বইয়ের পাতা উল্টে চরকি আড়চোখে শিরিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, বেশ কিছুটা সময়। চরকি অনন্যা করিমের ডাক নাম। রেড অক্সাইডের ফ্লোরে শীতের রোদ পড়েছে তেরছা করে। পুরোনো এই বারান্দাটা বেশ লম্বা-চওড়া । দাদার আমলের তিনতলা বাড়ির দোতলার বারান্দায় গোল একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে বই পড়ছেন পঞ্চাশোর্ধ চরকি, আর মাঝেমধ্যে রিডিং গ্লাসের ফাঁকে হাউজমেইড শিরিনকে দেখছেন বিরক্তির চোখে। চরকির চোখের নিচটা ফোলা আর কালসিটে, ইদানিং ঘুমের ব্যাঘাত তার প্রায় নিত্যদিনের। স্মার্ট এই মহিলা যেন হঠাৎই বুড়িয়ে যাচ্ছেন, গলার নিচে ভাঁজ পড়েছে, তা নিয়ে অবশ্য চরকির বিশেষ মাথাব্যথা নেই। মাথা ঘামানোর মতো যথেষ্ট জটিল কা- এখন তাকে সামলাতে হচ্ছে। বাবা জায়েদুল করিম মারা গিয়ে বিপত্তিটা বাঁধিয়েছেন। চরকি থাকতেন বিদেশে, প্রায় বছর বিশেক বাদে এসেছেন অল্প কিছুদিনের জন্যে। বাক্সপ্যাটরাও সব খোলা হয়নি। চরকির বাবা করিম সাহেব দীর্ঘকাল ফরেন সার্ভিসে কাজ করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বাংলাদেশের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই। রিটায়ারমেন্টের পর অবশ্য পৈত্রিক বাড়িটাতেই থাকতেন তিনি। কিন্তু এই দায়িত্বশীল মানুষটিই এমন অস্বস্তির একটি ব্যাপার ঘটিয়েছেন যা চরকির আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে বলবার মতো মুখ নেই। কাল সারারাত তিনতলার কাঁচঘরে মেডিটেশন করার সময় বুড্ডার মুখ মোচওয়ালা বোয়াল মাছের সাথে ভেসে উঠছিল। বুড্ডা তার বড়ভাই, মৃত। পুরো নাম পিয়াস করিম। ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা, গ্রামের বাড়ির নানান কথা, ত্রিপলীর কথা, কেনিয়ার এক গ্রামের কথা, কামলা হারুর বোকামীর কথা, আরো কতো কতো কথা। কথা, শুধু কথা। এখন অবশ্য চাকর শিরিনকে নিয়ে ব্যস্ত। মাঝকুড়ির স্বাস্থ্যবতী শিরিন বারান্দার এক কোনায় কাপড় আয়রন করতে করতে টের পায়Ñ ম্যাডাম বই খুলে তাকিয়ে আছেন তারই দিকে। কাফ্তানের একদিকটা টানটান হয়ে গেছে, উল্টে অন্যপাশটা আয়রন করার সময় শিরিন একবার চোখ ফিরিয়ে ম্যাডামকে দেখে কাজে মনোযোগী হয়। ভীতু চাকরদের চোখ-কান পরিস্কার রাখা জরুরী। ‘খেলা। খেলাÑ তাই না? যে ভয় পায়, আর যে ভয় দেখায়, দুই জনের জন্যই এটা একটা খেলা। খেলা-খেলা। সারাবেলা। আর এই খেলাটা জমে ওঠে যদি দু’জনই ভালো পারফর্মার হয়। আমি স্টেজ পারফর্মেন্সের কথা বলছি না। আমার ধারণা, তুই আমার কথাগুলো ফলো করতে পারছিস।’ ‘জ্বী ম্যাডাম, না, মানে,আমি কি কোনো ভুল করেছি?’ শিরিনের এইধরনের অনির্দিষ্ট প্রশ্নবাচক কথা চরকি পাত্তা না দিয়ে বলে চলেছেন নানান কথা।

‘এই যে প্রকৃতি আমাদের দু’টো চোখ দিয়েছেন, কিসের জন্য? দেখার জন্য। দেখা। শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকার জন্যে নয়! বাট হোয়াট উই ডু? উই অনলি লুক। উই ডোন্ট সি! অল ফুল্স। আবার এই যে তুই আমার দিকে তাকিয়ে আছিস। এই, এইযে… চোখটা নামিয়ে নিলি। তাকিয়ে কি দেখলি?… ঐ এক মুহুূুর্তের মধ্যে তুই আমার চোখের ভেতর ঢুকে আমার মনের ভেতরটা দেখে নিতে চাস। এ্যট এ গ্ল্যান্স। পলকমাত্র। নিজের সিকিয়্যরিটির কথা ভেবেই তোকে এই কাজটি করতে হয়। রাইট?’ শিরিন ইস্তিরিটা দাঁড় করিয়ে রেখে মাথা নাড়ছে, যেন কিছুই বুঝছে না, ‘ম্যা ডা ম!’ ‘এত ম্যাডাম-ম্যাডাম করবি নাতো! এখানে, এই আমার পায়ের সামনে এসে বস।…বস। এ্যই ভয় পাচ্ছিস কেনো? আয়, বস। পায়ের তালুটা একটু ম্যাসাজ করে দে।’ শিরিন খুবই বিভ্রান্ত। গোলাকার সোফায় গা এলিয়ে বইটা বুকের ওপর ফেলে রেখে চরকি কথার চক্কর দিয়েই চলেছেনÑ ‘সোলায়মান আমার ড্রাইভার, রাইট? আর তুই সোলায়মানের কাছে ফোন চেয়েছিলি, ক্যানো? তোর না সেভেন্টিটু আওয়াস্ ফোন ধরা নিষেধ! তার মানে তুই একজন স্লেভ হয়ে, তার মনিবের কথা শুনিসনি। আমাকে গ্রাহ্য করিসনি! টু ব্যাড!’ শিরিন এবার ভয় পেয়ে যায়। ‘জ্বী। ম্যাডাম, মানে বাবা নিশ্চই খুব টেনশন করছিলেন ভেবে… আর বাসার সঙ্গে একটু কথা বলার দরকার ছিল। আজ সতের তারিখ, আমিতো এ মাসের টাকাটা দিয়ে আসতে পারিনি! প্লিজ ম্যাডাম, আর হবে না।’ ‘হয়েছে, ফের মিথ্যে কথা! আর, এতো ভয় পাবার কী হল? তোর সব ভয় জয় করার চাকরি আমি নিয়েছি? বল, চুরি-চুরি ক’রে অন্যের কাছে চাওয়ার আগে আমার কাছেই ত চাইতে পারিস, তাই না! বেডরুমে ড্রেসিংটেব্লের ওপর রাখা আছে ফোনটা, নিয়ে নিস। আর, সোলায়মানকে নিয়ে একসময় তুই তোর বাবা-মাকে দেখে আসিস। এখন তুই বস। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। চোখে চোখ রেখে আমি কিছু কথা বলতে চাই। শুনতেও চাই। কই বস্। পায়ের গোড়ালিটায় একটু ভালোমতো চেপেচেপে দিবি।’

উপায়ন্তর না দেখে, ইস্তিরির প্লাগটা পয়েন্ট থেকে খুলে শিরিন গোল চেয়ারটার কাছে বসে। চরকিও পা’টা নামিয়ে দিয়ে একটু ঝুঁকে আসে। তার পায়ের আঙুলগুলি নিয়ে শিরিন নাড়াচাড়া শুরু করেছে। ‘তাকা আমার দিকে। ভয় নেই, আমি তোর চোখ গেলে দেব না। তাকা। স্ট্রেইট চোখের দিকে তাকা। আইবলের ভিতরে আরেকটা রিং দেখা যাচ্ছে না, ঠিক সেইখানটায়।’ শিরিনের মুখ শুকিয়ে আছে। তবুও প্রাণপন চেষ্টা করে চোখের দিকেই তাকিয়ে থাকতে। একজোড়া পাগল চোখে এতক্ষণ চেয়ে থাকা যে কতটা কঠিন! চরকিচোখে বিপদের আভা টের পাচ্ছে শিরিন। শিরিনের বুক কাঁপতে থাকে। সে ভয়ে ঘামতে শুরু করে। চরকির নানান পাগলামির চেহারা এই কয়বছরে দেখে দেখে সে ক্লান্ত। রাতজেগে পেন্সিল হিল পড়ে এই আড়াইতলা বাড়িতে টুক্ টুক্, টাক টাক, টাক শব্দ তুলে হাঁটা আর বিড়বিড় ক’রে কথা বলা, আবার হঠাৎ হাসির দমক। ‘শিরিন!…’ ডাক শুনলেই তার আত্মা শুকিয়ে যাবার জোগাড়। গভীর রাতে শিরিনের দরজায় নক তার প্রায় নিত্যকার অভ্যাস। সারাদিনের প্রাণান্ত পরিশ্রমে যখন শিরিনের চোখের পাতারা একটু বিশ্রামে মুদে আসে তখনই শুরু হয় তার নানান বায়নাক্কা। ফ্লোরে শুয়ে ছবির জন্যে মডেল দাও। ঘুমন্ত শরীর। মরা মানুষের ছবি আঁকে চরকি ম্যাডাম। সেইসব ছবি নাকি আবার বিদেশের আর্ট গ্যালারীতে বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। এইসব নিয়ে অবশ্য শিরিনের বিশেষ চিন্তার অবকাশ নেই। অনেক বেতন তাকে দেয়া হয়, বিনিময়ে একরকম বান্দীর মতো কাজ করতে হয়। চরকির ভাষায়, ‘স্লেইভ। বন্ডেড লেবার।’ দাসী ত বটেই, এই দাসীর আয়ে চলে তার নিজের বাবা-মা’র সংসার। ইংল্যান্ড থেকে চরকির সঙ্গে সে ঢাকায় এসে শহর থেকে একটু দূরের এই বাংলোটায় উঠেছে প্রায় মাসদ’ুয়েক। জায়েদুল করিম গত হয়েছেন প্রায় আড়াই মাস। একযুগ এই পিতা-কন্যার সামনাসামনি দেখা নাই। এখন পিতার বিষয়-আশয়ের খোঁজখবর করতে ল’ইয়ারের সাথে প্রায় প্রতিদিন মিটিং আর কাগজপত্র ঘাঁটাঘাটি নিয়ে ব্যস্ত অনন্যা। নানান রকমের লোকের আনাগোনা বাড়িটায়, সারাটাদিন রীতিমতো চরকি কান্ড। দু’এক সপ্তাহেই তারা আবার ফেরত যাবে, মাঝথেকে বাবা-মা, বিশেষ করে নিজের দিদার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগটাই শিরিন বড় করে দেখেছে। চরকি যে আজ তার গভর্নেসের সঙ্গে কেন এতো কথা বলছে ব্যাপারটা শিরিনের মাথায় আসছে না। ভয় তাই আরো বেশি আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। মহিলাকে কোন বিশ্বাস নেই। রাতে তার মডেল দেবার পাগলামির অংশ হিসেবে প্রায় নগ্ন হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল ফ্লোরে । ঘুম ভেঙে শিরিন আবিস্কার করে ফ্লোরের মাঝে তারই পাশে চরকি-ম্যাডাম! একেবারে সে যে ভঙ্গিতে শোয়া ছিল প্রায় ঠিক তেমনটা। আশেপাশে ছিটিয়ে থাকা ড্রইং দেখে সে রীতিমত অবাক। লজ্জাতুর, লাল হয়ে উঠে শিরিন। প্রতিটি ড্রইংয়েই তার গায়ে একবর্ণ সুতা নেই, নেই কোনো আড়াল! শিরিনের অবাক হবার কারণ হলো আঁকা শরীরের লজ্জাস্থানগুলি, যা অবিকল তারই মতো! তার মানে কী? ‘একজন পারফর্মার কখন ভালো করে জানিস? যদি সে তার চোখটা অন্যকে রিড করতে না দেয়। মনের ভেতরে যে রিয়্যাকশনগুলো হচ্ছে সেটা আনন্দের হোক, বেদনার হোক, যাই হোক। সেটাতে যদি সে পর্দা টেনে দিতে পারে, তাহলেই তার পক্ষে বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করাটা সহজ হয়। অ্যাই তুই এখন কি ভাবছিস–বল। স্পিক আউট।’ বলে অনন্যা করিম চশমা দিয়ে শিরিনের মাথায় খোঁচা দেয়। শিরিন ঘাবড়ে যায়। চুপ করে থাকে, ম্যাসাজ নিয়ে ব্যস্ত হবার ভঙ্গি করে। চরকি বলে চলেছে, ‘তুই ভাবছিস, এই পাগল মহিলা… চরকি বিবি এখন কি-না-কি বলবে, আর কী-না-কী চরকিকান্ড করবে তার ঠিক নাই। ঠিক? তুই আরও ভাবছিলি, ভাবছিলি… কানামুন্সি লোকটাই সব হাঙ্গামার মূলে। ম্যাডামের বাবার প্রপার্টি নিয়ে কোনো একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে এতিমখানার ম্যানেজার এই মুন্সি ব্যাটা।’ এবার শিরিন রীতিমত ভড়কে যায়। চোখ নামিয়ে ফেলে। হঠাৎ শিরিনের চোখের পাতার পাপড়িগুলি তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে। ভ্রূ-কুঁচকে, চোখপাকিয়ে সে পাপড়িগুলিকে আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করতে থাকে, প্রায় নিঃশব্দেই। সিঁড়ি বেয়ে চরকি আয়নাঘরে, তার মেডিটেশন রুমে ঢোকে, পিছুপিছু মাথানিচু শিরিন।

‘দেখ। দ্যাখ, আমরা কত সহজেই না মশা মারতে পারি। কই, কামান ত দাগি না। মাছি মারাটা কঠিন কেন জানিস? আমরা বেশিরভাগ মানুষ একবারে ১৮০ ডিগ্রির বেশি দেখতে পাই না কিন্তু মাছিরা দেখতে পায়, তাই। গরু পায় আরো বেশি । দ্যাখ তুই নিজে ট্রাই করে দেখ, তুই ওয়ানএইট্টির বেশি পারিস কিনা। দুই হাত প্রসারিত কর… পৃথিবীকে দুইটুকরা করার বদলে আন্দাজ করাটাই সহজ না? এইবার দুই হাতের মধ্যমাকে একটি সরলরেখা করলেই আমরা ১৮০ ডিগ্রি পেয়ে গেলাম। ট্রাই করে দ্যাখ, আয়নায় নাক বরাবর তাকা। তাকিয়ে দুই হাতের মধ্যমাকে কার্ভ হতে না দিয়ে, স্ট্রেইট রেখে দুই মধ্যমাকে আই-সাইটে আনতে কী পারছিস? আই গেজ, নো!… তাহলে এই দৃষ্টির বেলায় আমি হচ্ছি মাছি, তুই মশা; আয়নাঘরে বসেই, আমি চাইলে তোর রান্নাঘর দেখতে পাই, কি রঙের সব্জি কাটছিস ওই ছুরি দিয়ে তা পর্যন্ত…ইভেন ক্যান সি-থ্রু ইয়োর হার্ট ! বাবার প্রপার্টি নিয়ে যে কমপ্লিকেসিটা তৈরি হয়েছে, তাতে তোর নাম আসছে; তোর শিরিন নামটাই কেন এলো?…এটা তুই আড়ি পেতে শুনেছিস। তুই যে চালাক, সেটা তুই জানিস। তাই আমি যখন তোকে তিনতলায় পাঠিয়ে ল’ইয়ার সাহেবের সঙ্গে নিচের লিভিংরুমে বসে কথা বলছিলাম, তুই তিনতলায় এই ঘরে আসার নাম ক’রে দোতলার সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়েই কান খাঁড়া করে দাঁড়িয়েছিলি, পায়ে পায়ে হাঁটার শব্দের পার্সপেক্টিভ তৈরি করেছিস!… এই জ্ঞান এদেশের দেশপ্রেমিক সিনেমা দরদী নবীন সাউন্ড রেকর্ডিস্টদের বিশেষ কাজে আসতে পারে, আমার নয়। চরকির শুধু চোখে ধুলা দিয়েই পার পাবেনা সোনা-মানিক শিরিনা’পু! কানেও বালি দিতে হবে; তার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে অবশ বা হত্যা করতে হবে!… ম্যাডাম-শিরিনের মনে এরকম ইচ্ছা কী জাগ্রত হয়েছ? কী! বল আমাকে খুন করে আমার বাবার সবকিছু দখল করতে তুই কার কার শরীর-মন-ইন্দ্রিয় সকল দখলে সমর্থ হয়েছিস?… কিন্তু সোনা তার আগে যে তোমাকে মরতে হবে। বধিত হইবার আগে, চরকি তার চাকরকে বধ করিল! ট্রান্সলেট ইট। কুইক!!’

চোখের পাপড়িগুলা যখন কাঁপতে শুরু করেছে তখনই শিরিনের মনে হয়েছে চরকি বিবির এই ভালোমানুষি আজ কোনো খারাপির দিকে টার্ন করতে বাধ্য। সে খেয়াল করে দেখেছে চোখের পাপড়ি কাঁপার সঙ্গে তার খারাপ কিছু ঘটার যোগ আছে। পরশুদিন যখন চরকিবিবি তাকে ছুরি নিয়ে তাড়া করেছিলো, ঠিক তার বিশ মিনিট আগে চোখ এইভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল। শিরিন ভয়ে কুঁকড়ে আসে। তার গলায় কান্নার দলা পাকিয়ে গো-গো’ একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসে। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে। ‘ভয় পাওয়ার ভালো অ্যাকটিং আর এই কান্না ভেজা চোখ, দুর্বল মানুষের খুব ভালো অস্ত্র। এটা সারভাইভ্যাল ইন্সটিঙক্ট…তুই বেশি চালাক। এই তুই আমার নাম ধরে ডাকত। অ ন ন্যা বলে ডাক। বল, চরকি বিবি। ঐ যে, যখন আমি বাসায় থাকি না, সেই সময় তুই যেমন মুখ ভেংচে আমার নাম ধরে ডাকিস অ ন ন্যা! অনন্যা! অ্যাই চ র কি কথা কানে যায় না! ঠিক ঐরকমভাবে ডাক। এখন আমার চারদিকে চক্কর খেতে খেতে ডাক। চরকি…চরকি…চরকি…চর্কি…চর্কি…চর্কি…অনন্যা!’

কথা, শুধু কথা!

চরকির ঠোঁটে মৃদু হাসি। তবে তা একপর্যায়ে ম্লান হয়ে আসে। হঠাৎ তার ভাই পিয়াস করিম ওরফে বুড্ডাদার কথা মনে পড়বে। গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়বে। খুব ভাল ছাত্র ছিল বুড্ডাদা। তার থেকে বছর চারেক বড় হবে। ক্লাস এইটে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলো বলে বাবা তাদের গ্রামের বাড়িতে একটা ভ্যাকেশন ট্রিপে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাদের দুইভাইবোনকে দিয়েছিলেন গ্রাম এক্সপ্লোর করার অবাধ স্বাধীনতা। পুরো গ্রামটাই যেন তার বাপের পয়সায় কেনা! ওই সময় বুড্ডার বরশিতে তার চেয়েও বড় একটা মাছ গেঁথে থাকবে। শিকার এবার টেনে নিয়ে যাচ্ছে শিকারীকে; একপর্যায়ে জলের গভীরে। বাড়ির কামলা হারু দেখেছিল বলে শেষ রক্ষা। কী করে জানি হারু তার অচেতন দেহটাকে জলের গভীর থেকে তুলে এনেছিল। সেই দৃশ্য বিবরণ করে আজও সে জাবর কাটে। দৃশ্যটা এরকম- ‘চৌমহলা বাড়ির উঠানের চারিদিকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে ভীত-বিহবল পরিবারের সদস্যরা ও উৎসুক গ্রামবাসি। কিশোর বুড্ডার পেটটা নিজের মাথায় চেপে এক হাতে দুই পা, অন্যহাতে দুই হাত চেপে ধরে বাই-বাই করে ঘুরাচ্ছে হারু। বাবা জায়েদুল করিম তখন পাশের গ্রামের চা-দোকানে আড্ডা দিতে গেছেন। বাবার তখন গ্রামে ইলেকশন করার হাউশ হয়ে থাকবে। মা হায়াতুন্নেসা উঠানে পড়ে থাকা বড়শি-গেলা বিশাল বোয়াল মাছের ঠিক কাছটাতেই বিলাপ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। পালোয়ান হারুর মনে হয় ইতোমধ্যে চার কুড়ি পাক দেওয়া হয়ে গেছে। ছোটবোন অনন্যা হারুর সঙ্গে পুরো বৃত্তটা বুড্ডাদা-বুড্ডাদা বলে চীৎকার করে চক্কর খাচ্ছে। এক পর্যায়ে বুড্ডা বমি করতে থাকে। তার এই বমি গিয়ে পরে হায়াতুন্নেসার গায়ের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের বমির ঘ্রাণে হায়াতুন্নেসার জ্ঞান ফিরে আসে। বুড্ডার বমির কিছুটা পরে বোয়ালমাছের ওপর। এতক্ষণ তসবি হাতে নিয়ে দাদা করিম খাঁ বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। তার চোখে মুখে কোনো ধরণের আশঙ্কা দেখা যায় নি। তার হুকুমে হারু বুড্ডাকে নামিয়ে দিলে হায়াতুন্নেসা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। অনন্যা তখনও চক্কর খেয়ে যাচ্ছে চরকির মতো। দাদু করিম খাঁ তাকে কোলে তুলে নেন। আর উপস্থিত গ্রামবাসিদের নির্দেশ দেন ‘এই মাছ কেউ ছোবে না।’ পুকুর পাড়ের গাবগাছের নিচে কবর হয় বোয়ালের। কিন্তু এতবড় মাছ দেখে কার না লোভ জাগে। আর যদি সে হয় অভাবী? এই আশঙ্কায় তিনদিন পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন করিম খাঁ। এই হারুই গাব গাছের তলায় রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। আর সেই থেকে চক্কর খাওয়া অনন্যা করিমের নাম হয়ে গেল চর্কি।

পাহারাওলা হারুর কাছ থেকে আমরা তিনরাত্রির গল্প শুনতে পাবো। একদিন বিল থেকে এই বোয়ালের সঙ্গী মাছটা নাকি উঠে এসে তার পায়ের কাছে অনেক কান্নাকাটি করেছে। ‘এই গল্প আর কোনোদিন কারো কাছে বলবে না’ কান ধরে হারুকে সেই শপথ করিয়েছিলেন দাদু করিম খাঁ। মাঝ বয়সের চিরকুমার হারু জায়গা জমি কাইজা ফ্যসাদে খুন হয়। ঐ ‘বিল-বোয়ালে’ আরও একটি গল্প এই বুড্ডার মাছ শিকার নিয়ে রয়েছে যেটি আরও বেদনার। বোয়ালমাছের কবর রচনার তিনদিন পার হলে হালিম শেখের পরিবার পঁচা মাছটি চুরি করে এনে রাতের অন্ধকারে রান্নাবান্না সারে। খেয়ে সাবাড়, কাটাকুটা গুলা মাটি চাপা দেয়। এগারো সদস্যের এই পরিবারের সকলেই ভেদবমিতে তিন দিনের মধ্যেই মারা যায়। সেই শোকের গল্প এতকাল বাদেও বোয়াল মাছ দেখলে গ্রামের মানুষের মনে পড়ে। বর্ষাকালে জলে ভরভরন্ত হলে বিলের দিকে তাকিয়ে গ্রামবাসিদের মনটা উদাস হয়ে ওঠে। শোকের গল্পটা পুনরায় মনে পড়ে। মাছ শিকারের নেশা থাকলেও বোয়ালের বিলে বুড্ডার আর যাওয়া হয়নি। বুড্ডাদা মেট্রিকে তিন বিষয়ে ফেল মেরেছিল। আর বাবার এমন পিটুনি… ট্রেনের তলায় মাথা দিয়ে তবে মুখরক্ষা।

নিচু একটা সোফায় বসে ল্যাপটপে মুখ গুজে মনোযোগ দিয়ে কিছু জরুরী মেইল পাঠাচ্ছেন চরকি। ফ্লোরে বসে তার পায়ের নখ নিয়ে ব্যস্ত শিরিন। ‘সাবধান, দেখিস আবার পা কেঁটে রক্তারক্তি করিস না।… ডিপ্রাইভড্ সোল, ছোটলোকদের বিশ্বাস নেই, সুযোগ পেলেই রক্তারক্তি করে ফেলবে… অ্যাই, তুই তাই চাস ?’ শিরিন মনে মনে বলে, ‘তুইও মর।’ ‘কী! তুই আমার মৃত্যু কামনা করছিস, তাই ত…’ শিরিন চমকে তাকায়, আবার নিচে তাকিয়ে অনন্যার পা আর নেইলকাটার নিয়ে ব্যস্ত হয়। মাঝে মধ্যে উপরে আড়চোখে তাকায়। অনন্যা অনেকটাই আপন মনে বলে যাচ্ছে ‘আর সময় নেইরে, অনেকদিন ত হল, এবার ফেরার পালা। কবে যে এইসব হাবিজাবি থেকে মুক্তি পাবো কে জানে!…তুই ত আর বিলাতে ফিরতে চাস না। পারবি এখানে সবকিছু সামলাতে?’ ‘জ্বী!’ ‘আবার চালাকি করিস! এখন থেকে হাফ অ্যান আওয়ার আমার সঙ্গে বসে মেডিটেশন করবি!’ ‘জ্বী, মাডাম, আপনি চাইলে নিশ্চয় করবো।’ মুখ ভেঙচে সুর পাল্টে অনন্যা, ‘অ্যাহ্ ..আপনি চাইলে করবো!…চাকরের জাত। পিঠের উপর চাবুক না পড়লে এক পাও নড়বে না! স্টুপিড ফুল! নাউ মেক এ্য ফুলস্টপ।… আচ্ছা তোরা কী নিজের রেসপনসিবিলিটি নিয়ে একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারিস না!…এদিকে ওদিকে অনন্যা খালি চেঁচাবে!…তুই ইচ্ছা করেই আরো আরো বেশি ক’রে চেঁচামেচি করাস! কী করাস না? বল!!’ ‘জ্বী না!’ ‘থাক আর বলতে হবে না, গতকাল তুই বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে আওয়াজ করে বললি আল্লা এই বেটির জবান তুলে নেয় না ক্যান। ইচ্ছা করে গলার ভিতরে একটা তেলাপোকা ঢুকিয়ে দেই… মরেওনা বেটি!’ অনন্যার গলার স্বর পাল্টে যাচ্ছে আর শিরিনের ভয়ের মাত্রা বাড়ে। ‘এই যে, অভিনয়টা হচ্ছে না! ঠিকমতো কর!..’. ল্যাপটপ বন্ধ করে নামিয়ে রেখে মুখ তুলে বেশ জোরে পাঠ করে একবার, দুইবার, তিনবার… একেকবার একেকরকমভাবে
‘ভয় এক নিষিদ্ধ আমোদ,
যার সঙ্গমে জন্ম নেয়
একেকটি মৃত্যুর পুতুল।’
কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে শিরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে চরকি। ‘কীরে! বুঝলি কিছু? মৃত্যুর পুতুল। পুতুল! ভয়ের পুতুল। খেলার পুতুল । অ্যাই তুই পুতুল খেলেছিস ছোটবেলায়? সংসার সংসার খেলা? পুতুলের বিয়ে, আড়িপাতা, সইপাতানো, ভালপুতুল খারাপপুতুল বরপুতুল কনেপুতুল ছেলেপুতুল মেয়েপুতুল বাবাপুতুল মাপুতুল পুতুলপুতুল…ভাইপুতুল বোনপুতুল শিরিনপুতুল…বোকাপুতুল চর্কিপুতুল চালকচতুর পুতুল…’

শিরিন একটু দূরে ফ্লোরে ব’সে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আছে। এই একটি সময় ম্যাডামকে তার বিশেষ খারাপ লাগে না। নির্দয় মহিলার কোন একটা ভাল দিক হয়ত আছে, নইলে তার মুখের কথা মাঝেমধ্যে শুনতে ইচ্ছা হয় কেন? ‘শিরিন!…’ শিরিন চমকে তাকায় হঠাৎ হুঙ্কারে। ‘মৃত্যুর পুতুল!… ভয় পেতে ভালো লাগে না! ভয় পাওয়াটা নেশা…ভয় পেতে পেতে ভয় পাওয়াটাই অভ্যাস হয়ে গেছে, না!’ শিরিন ধমক শুনে মাথা নিচু করে থাকে। ‘আমি খুশি চেঁচিয়ে, তোর খুশি আমাকে চেঁচামেচি করিয়ে। তোর ভালোলাগে ভয় পেতে, আমার ভালোলাগে দেখাতে। অ্যাই তুই, এতো যে ভূত ভয় পাস দেখেছিস কোনদিন?’ শিরিন মাথা নাড়ায় না’সূচক। ‘হু না-দেখার ভূত। তোরাও না! একেকটা ভূতের মানুষ। মানুষের ভূত। ভূত, ভূতের ছানা, ভূতের পো হা.হা.হা।’
চরকির কান্ড দেখে শিরিন একটু মুখ টিপে হাসে। চরকি সেটা খেয়াল করলেও এড়িয়ে যায়। ‘তোর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে?… বাবা-মা, ভাই-বোন, খেলার সাথী এদের কথা?’ ‘পড়ে, মাঝে-মধ্যে।’ ‘বাবা-মার কথা কী মনে আছে তোর শুনি।’ ‘তেমন কিছু না তবে একবার আমার জন্মদিনে ইয়া বড়, আমার সমান একটা পুতুল আর বাক্স বাক্স চকলেট পাঠিয়েছিলো এক কাকু। বিদেশী কাকু। তারপর হয়েছে কি শোনেন, মা’র এমন রাগ!… সেই পুতুল চুলায় ছুঁড়ে পুড়িয়ে মারে।’ ‘ক্যান তোর মা এমন করলেন কেন? চকলেটগুলি কে দিয়েছিলো শুনি?’ ‘কে দিয়েছিলো?.. দিদামনি বলেছিলো মায়ের এক বন্ধু বিদেশ থাকে সে। মা’তো বিদেশেই কাজ করতো। আমি অবশ্য জন্মের পর মাকে কখনো বিদেশে যেতে দেখি নাই। তারপর শুনেন না, দিদার যে কি রাগ… সেই পুতুল পোড়ানো নিয়ে মায়ের সঙ্গে কী খারাপ-খারাপ ঝগড়া!’ ‘হ্যা’রে তোর যে দিদা, তার বয়স কত?’ ‘বুড়ি বলে চার কুড়ি। আশি। আবার বলে, কবরে পা দিয়ে বসে আছি। বলে কি- মরতে চায়না, ভয় পায়…’ ‘মৃত্যুর ভয়? তুই ভূতের ভয় পাস, মরতে ভয় নাই?’ ‘নাহ! সবার যখন মৃত্যু হবে, আমারও হবে, এতে ভয়ের কি?’ ‘মৃত্যুতে ভয়ের কিছু নাই বলছিস? আচ্ছা তুই এইবার আমাকে বল, কোনো এক্টিং না, তুই এইযে আমাকে ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করিস, সেটা করিস ক্যান?’ ‘অ্যাক্টিং না ম্যাডাম। সত্যি সত্যি ভয়..’ ‘সেই ভয়টা কি শুনি, কিসের ভয়? আমার চেহারা ভয়ঙ্কর?’ ‘ম্যাডাম সোলায়মান কী বলে শুনবেন? বলে, হয় আপনের মাথায় ছিট আছে, নইলে আপনের উপরে বদ জ্বিনের আছড় পড়ছে।’ ‘তাই বলেছে তোকে সোলায়মান, আসুক কালÑ আমি ওর ঘাড় মটকাবো…’ ‘আমি ওকে আচ্ছা মতো বকে দিয়েছি। দেখেন এমনিতে সাতচড়ে রা’ নাই, আসলে একটা মিচ্কা শয়তান। সারাক্ষণ মুন্সির সঙ্গে, নইলে অ্যারন ভাইয়ের সঙ্গে কি-কি যেন শলা করে, নানান ধান্দা ফিকির করে। আইলসামি করতে করতে ব্যাটার মাথাটায়Ñ না হইলেও একশ একটা শয়তান বাসা বানাইছে। চাকরির ভয় দেখিয়ে এমন ধমক দিয়েছিলাম জিন্দেগীতে আর বাজে কথা মুখে আনবে না।’ ‘বেশ। ও ভয় পেয়েছে বলে তোর মনে হয়?’ ‘হানড্রেড পার্সেন্ট।’ ‘এবার দ্যাখ এটা হচ্ছে পাওয়ার প্লে। ইট ইজ অল অ্যাবাউট প্লেজার। আমি ভয় পাই মৃত্যুকে, তুই ভয় পাস আমাকে, সোলায়মান ভয় পায় তোকে, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সোলায়মানকে ভয় পায়…জগতের নিয়ম মেনে।’

শিরিন কিছু একটা ভেবে খিলখিল হাসে। চরকির চুলে বিলি কেটে দেয়। ‘ম্যাডাম ওকে কে ভয় পাবে! ও কাউকে ভয় দেখাতেই পারে না। ওর পছন্দ ভয় পেতে। সোলেমান ওর বৌকে যে কী ভয় পায় আপনি দেখলে বুঝতেন, ইয়া মোটা আর কী তার মেজাজ! যেন কড়াইয়ের মধ্যে তেল ফুটছে দিন-রাত। বৌয়ের ফোন আসলে তার আত্মা শুকায় যায়। রিঙ্গার টোন আলাদা করে সেট করা আছে বউয়ের নামে।’ ‘দাঁড়া দাঁড়া… আমি মনে হয় তাকে দেখেছি, কই দেখলাম, দেখলাম…অ্যারনের ডকুমেন্টারিতে…’ ‘বলছিলাম না ম্যাডাম সোলেমান একটা ভেজা বিড়াল, অ্যারন ভাইকে দু’চারদিন বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসে পটানো সারা। এখন নিজের বৌয়ের অ্যাড বানিয়ে নিয়ে নিচ্ছে।’ ‘তোর শখ হলে অ্যারনকে বল, ও ত তোকে পছন্দ করে। তোর জন্যে ফিচার ফিল্ম বানিয়ে দিবে। তুই করবি হিরোইনের পার্ট…আহা আরেকটু আস্তে কর, ব্যথা দিচ্ছিস ক্যান?… তোর এক্স হাজব্যান্ড ফোন করে?’ ‘এখন কম। বেশ কয়েকদিন… খালিখালি… ব্যাটা দেখেন, বিয়ের সময় বললো সে যৌতুক ত চায়ই না, উল্টা ঘৃণা করে… ওমা নিজের অবস্থা একটু খারাপ হল…’ ‘তুই কি অ্যারনকে বিয়ে করবি? ওতো ডিভোর্সড…ওর বাসায় গিয়ে ত বেশ ক’দিন ডেট মেরেছো…কী চুপ করে গেলি ক্যান?…তুই কিন্তু এক্টিং করি না বলে, আমাকে ভয় কেন পাস সেই প্রশ্নটা থেকে গল্পটা অন্যদিকে নিয়ে গেছিস…’ শিরিন এবার চমকে যায়, ধরা পড়েছে। ‘আসল কথাটা এড়িয়ে গেছিস!… তুই আসলে এই চাকরিটা হারানোর ভয়ে থাকিস। এইত?’ ‘সত্যি আপনি জ্বিনভুত পুষেন। সব-জানি কী ক’রে জেনে যান সেই ভয়।’ ‘হু অবজারভেশন… মেডিটেশন। সেম প্র্যাকটিসটা তুই অনেককাল আগেই খেয়াল ক’রে ক’রে নিজেই রপ্ত করেছিস। তুই একটা মহা চোরÑ এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ তুই একটা ছিঁচকাদুনে ভীতুর জামা পড়ে নিজেকে আড়াল করেছিস। আমার সঙ্গে চোর-চোর খেলা খেলে যাচ্ছিস। তোর ভালো লাগে? আমার লাগে না। মৃতের শহরে চোর-চোর খেলা তোর ভাল লাগলেও আমার লাগছে না। …চারিদিকে সব মৃতের মিছিল। একদিন, একদিন সোলায়মানকে নিয়ে বের হয়েছি। দেখি চারিদেকে লাশ, সারি সারি মানুষের লাশ কিলবিল করছে রাস্তায়, ফুটপাতে সব জায়গায়। সামনে গাড়ির লাশ, পেছনেও তাই, শব-শকট। শকট বুঝিস? বুঝবি কিরে মর্কট, সর! বাড়িঘরগুলিকেও মনে হলো সার সার মৃতবাড়ি। পুরো শহরটা একটা মৃতের শহর। কোনো একদিন প্রাণ ছিলো। বুড়িগঙ্গা। গঙ্গাবুড়ি। আজ গতকাল। কতকাল গতকাল। কাল। আগামীকাল?… ধর, আগামীকাল গত হয়ে আজ তুই অনন্যা হলি আর আমি শিরিন…অথবা, অথবা দুইজনই শিরিন কিংবা অনন্যা। তাহলে তুইও শিরিন, আমিও শিরিন; কিংবা অনন্যা-অনন্যা। আর ধর…আচ্ছা, তোর বাবার নাম যেন কী?’ শিরিন অংক মেলানোয় ব্যস্ত, কোন দিকে যাচ্ছে চরকি বিবিÑ ‘জ্বি, আনসার আলী!’ ‘তাহলে ধর, আমাদের দুইজনেরই যদি বাবার নাম ‘আলী’ কিংবা ‘করিম’ হয় তাহলে অংকের মাস্টার বলবেন, ২=৩। আবার তখন আমাদের দুইজনের সম্পর্ক চাকরÑমনিব, মনিবÑচাকর না হয়ে দু’জনেই চাকর অথবা মনিব। তখন আমরা হইÑ দুই বোন। আমাদের ‘কমন বাবা’র পদবী অনুসারে আমি হই অনন্যা করিম, তুই শিরিন করিম। তাহলে দেখ, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে না? যে ভয় দেখায়, আর যে ভয় পায়… সব একাকার। তেল-জল মিশে যাচ্ছে একাকার হয়ে অতল অন্ধকারে, ‘ভয় এক নিষিদ্ধ আমোদ, যার সঙ্গমে জন্ম নেয়Ñ একেকটি মৃত্যুর পুতুল।’ চরকি ধীরে ধীরে ইনসেন হয়ে উঠছেন। ভয়ঙ্কর হিস্টিরিয়া শুরু হয়েছে তার। ‘আহা, কতো কতো পুতুল ফুটেছে…’ ‘বাস্টার্ড…অ্যাই তুই কে রে? এখানে কী? তোর মা হুসনা, তাইত? ও ওই চুন্নিটা তোকে পাঠিয়েছে অদৃশ্য ছুরি হাতে, তাই না? অ্যাই হুসনা তোর কোমরের কাপড় তুলে ছ্যাকাটা দেখা, দাগ এখনো যায়নি তাহলে… আবার পুতুল চুরির জন্য আসছিস? বুঝি না মতলবী! কী বল, মৃত্যুর পুতুল।… ব্লাডিস্টুপিডমেইডফাকারঅ্যাস্যোল …আই উ’ল কিল, আই হ্যাভ টু কিল…আই মাস্ট…আপেল, আপেলকাটার… ছুরি! ছুরি তুই চুরি করেছিস.. আমার ছুরি..আপেলকাটার!!’ অনন্যার হুঙ্কারে শিরিন এবার সত্যি ভীত, অনন্যা কিছু একটা খোঁজে, সেটা ছুরি। ঘর থেকে তেড়ে আসেন ছুরি হাতে। তক্ষণ শিরিন দৌড়ে নেমে আসে, সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মাঝ বরাবর ঝোলানো পর্দায় বেঁধে পড়ে যায়, শিরিন পড়িমড়ি করে ‘বাবাগো-ও খুন করে ফেললো …’ দ্রুত দৌড়। রান্নাঘর থেকে নিজেও একটা ছুরি নিয়ে দৌড়। নিজের ঘরে ঢুকে শিরিন দরজা বন্ধ করে। অনন্যার বিকট হাসি।

রাতের আঁধারে বাইরে থেকে বাড়িটাকে একটা ভূতের বাড়ি মনে হয়। নিজের ঘরে ছুরি হাতে একা শিরিন। কিছুক্ষণ পায়চারি করে, ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আবার উঠে দৌড়ে গিয়ে অন্য দরজা-জানালা চেক করে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে, মুখ বিকৃত। বিড়বিড় করে। সেও অনেকটা অনন্যার মতোই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। ‘ক্রে,ক্রেইজি ওম্যান… মাথা নষ্ট বেটি! চরকির চক্করে এখন নিজের মাথা নষ্ট করে না সোনা।… অনন্যা করিম, শিরিন করিম! অ্যা, বাবা… আলীভাই, না করিমসাহেব… মা ফর্সা আমি ফর্সা, ঠিকাছে আমি ফর্সা বাবা কালো, বোবাকালা অ্যাঁ পাগলটা এগুলা কী বললো! উফ্, এই ডাইনির সঙ্গে থাকতে থাকতে …মাথার ভিতরে এমন ক্যানো লাগে..না ছাড়ো, অ্যারন না, এভাবে না… দাদি! এই পুতুল খেলার সময়…মা কাইড়া নিলো, গলা ফাটায়া রক্তবমি করলাম…দিদা তুমি তারে ক্যান বললা নষ্টামেয়ে! আহ্ মাÑ লাগেতো গলাটা ছাড়ো, দম নিতে পারি না ত। কেন মেরে ফেলতে চাইলি আমাকে! কি বলছিলো মা’র কথা? হ্যা আমার মায়ের নাম হুসনা, চরকি তা জানে ক্যামনে!… ইস্তিরির ছ্যাকাটা, তাও? উফ্… বাবাগো!… বাবা।’ মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে ফ্লোরে। আস্তে আস্তে মাথা ভাঁজ করে ফ্লোরে শুয়ে থাকে কুকুরকুন্ডুলি পাকিয়ে, অনেকটা ভ্রূণের মতোই। ছুরিটার পাশে পড়ে থাকা ঘুমন্ত মুখটার চোখ কুঁচকে একটু নড়ে চড়ে।

পুতুলগাছ

পুতুল গাছে পুতুল ফুল ফুটেছে। শিরিন একটা পুতুলগাছ তলায় ঘুরঘুর করে। সারিসারি পুতুলের মাঝে হেঁটে বেড়ায়, লোভী চোখে তাকায়, ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে কিন্তু হয়ত ছোঁয়া মানা। এদিক সেদিক দেখে চুরি করে আলতো হাত ছুঁইয়ে যায়। ভালো লাগে তার। অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভূতি সারা শরীরে… কিছুদূর গিয়ে আবারও ফিরে আসে। ভয় পাওয়ার নিষিদ্ধ আমোদ। সে এবার একটা পুতুলকে ধরে বাচ্চাদের আদর করার মতো করে, মগ্নভাবে আদর করে। আবেশে তার চোখ বুঁজে আসে। একটু চেপে দিলে পুতুলটা প্যাঁ-পোঁওওওও আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠে। দূর থেকে চরকির কন্ঠ ভেসে আসে। ‘হুজ দিয়ার! হেই, য়্যূ! হুস্নাÑ ওয়ান্স এগেন! হ্যাভ’ন্ট আই টোল্ড য়্যূ নট টু টাচ্ মাই স্টাফ …হেই য়্যূ, ক্যান্ট য়্যূ হিয়ার মি!’ ছুরি হাতে চরকি। বীভৎস তার চেহারা। ‘হুসনা, বিচ্! ইফ্ ইয়্যু ওয়ানা হ্যাভ ওয়ান, গো এন্ আসক্ য়্যুর কারিম আঙ্কল… শিরিনের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ, মাথা নিচু অপরাধী। আর চরকি একবার শিরিনকে ভাবে শিরিন, আরেকবার ভাবে শিরিনের মা, হুসনা। ‘এন্ লিসেন্ কেয়ারফুলি, ইফ্ য়্যু ট্রাই টু স্টিল ওয়ান, আ’ম গনা হুইপ্্ য়্যুর অ্যাস্ টিল ডেথ্! হুসনা! ডিড য়্যু হিয়ার মি?’ ধরা পড়া চোরের মতো ভীরু অশ্রূসজল চোখে ধীর পায়ে কিছু দূর এগিয়ে শিরিন হঠাৎ থেমে যায়, একমুহূর্তের জন্যে চরকির চোখে তাকায়। তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্রবেগে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে টেনে ছিঁড়ে পুতুলের গাছ। অনেকটা শস্ত্রবেধাঁ শরীর নিয়ে পশু যেভাবে আমৃত্যু গোঙায় সেইরকম পাশবিক যাতনায় দাঁত-মুখ খিঁচে মাটিতে ফেলে পুতুলগুলি পায়ে দলতে থাকে; দাঁতে ছিঁড়তে থাকে একটা পুতুলের শরীর। চরকি প্রথমে এই স্পর্ধায় ভীষন অবাক। বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে সে হাতের ছুরিটা নিয়ে প্রবল বেগে এগিয়ে আসতে থাকে শিরিনের দিকে। শিরিনের বিস্ফারিত চোখের পাতায় একটি.. দুইটি… তিনটি ঝাঁকুনি। অনুভূত হয় শরীরের গভীরে ঢুকে পড়া ধাতব কিছু; যা পরক্ষণেই তার চোখের পাতায় অন্যতর এক অনুভূতি যোগায়, যা গোপন; গভীর কুয়ার তলানিতে দেখা হুসনাÑহু..সসস..না… বিম্বের আর ধ্বনির নকল। পুতুলগাছের পুতুলেরা হুহু বাতাসের দোলায় মাতম তোলে। নিচে কুকুরকুন্ডুলি পাাকিয়ে শুয়ে আছে শিরিন। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেÑ
‘উফ্ মা! মাগোÑ
ক্যানো জন্ম দিতে গেলি এতো রক্তপাত করেÑ
আর, আজ আমি রক্তাক্ত প্রতিদিন।’
ভ্রƒনের মতো কুঁকড়ে আছে শিরিন। ফ্লোরে একটা ধাতবকিছুর ঘষার খস্ খস্ শব্দে চোখটা খোলে, পেটের ভিতরে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে রক্তাক্ত কিনা, বেঁচে আছে না-কি মরে গেছে। সে বুঝে, দু:স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু মেয়ে, তুমি জানতে না, দু:স্বপ্নের শুধু শুরু আছে শেষ বলে কিছু নেই। দরজায় নক্Ñ টক্ টক্, টক্ টক্, টক্ টক্। আগের ভয়টা আবার মাথায় চড়ে, অনন্যার গলা শুনে। দু’হাতে মাথার চুল টেনে সে শক্ত হয়ে থাকে। একটু নৈ:শব্দ; নি:শ্বাসও পালিয়েছে যেন। নি:সহায় চোখ দুটি এদিক-ওদিক কিছু খুঁজে। পায়ের তলায় ছুরির ছোঁয়া। আস্তে করে ঝুঁকে ছুরিটা হাতে নিয়ে মুঠো শক্ত করে। অস্ত্র হাতে এলে চোয়াল শক্ত হয়ে আসাটা কেমন? সদ্যোজাত শিশুর মুখ মাতৃস্তনের বৃন্ত খুঁজে নেয়ার মতোই সহজ স্ব^াভাবিক। তরল।
দরজার তলায় একটা ছুরির ফলাকা এসে ঢুকে আর বের হয়, যেন অপক্কযোনী দরজা ফালাফালা করে দিয়ে যায় আর আসে এক ঝানু ধাড়িয়াল ছুরিয়ালÑআসে যায়Ñআসে, আসে যায়Ñ, উফ্ মাগো… দরজার নিচে গড়িয়ে আসছে রক্ত; সভ্যতার মানচিত্র। শিরিন হঠাৎ কী মনে ক’রে গা নরম করে আনে। রক্তের আদিম টানে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে আসে। রক্তে পা ভেজায়, উবু হয়ে বসে দরজার দিকে মুখ করে। আঙুলের ডগায় মেখে লাল রক্ত চেটে দেখে। এবং আশ্চর্য, শিরিন যেন অন্যন্যারই এক রূপ। দুইবোন। এক আর এক মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দু’পায়ের ফাঁকে গড়িয়ে আসা রক্তের ধারাটা উবু হয়ে দেখে। যেন তারই জন্ম যোনীদ্বার ফেঁটে বেরিয়ে এসেছে এই রক্তাক্ত পুতুল-ইতিহাস। হুসনাপর্ব; মাতৃ-ইতিহাস। ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে, তখনো মুখটা দরজারই দিকে। দরজায় নকÑ টক টক ট্ক। হঠাৎ শরীরে কোনো বিদ্যুৎ সঞ্চার হয়ে থাকবে, হালকা কাঁপুনি; শিরিন দরজার দিক থেকে একবার এক দিকের কাঁধে মুখ ফেরায়। এবার দেখি রক্তচক্ষু চাহনি। ভীত চোখ নয় মোটে, বরং উল্টো তাকে দেখেই ভয় পাবে যে কেউ। অষ্টপদবিপরীতমুন্ডুপ্রবঙশনিকাশপর্ব। শিকার এবার ছুটছে শিকারীর পিছে। হাত চলে যায় পিঠে, সব সহ্য করেছি বলে পিঠের চুলকানি, তাও? কিন্তু শিরিন নিজেই অবাক, সমুদ্র গভীরতা মাপতে হিমালয়-মাপকাঠিটির অকার্যকরতা জ্ঞান করে চরকি প্রণীত মেডিটেটিভ। ধ্যান। জেন। টুপটাপ এক-দুই-তিন-চার… এভাবে রক্তফোঁটা চুঁইয়ে ফ্লোরটা ভিজিয়ে দিচ্ছে বিস্মৃত কথামালাÑ
‘পিঠ চুলকায়।
হাতটা পিছনে বাড়িয়ে দেই।
আঙুলে তীব্র খোঁচাÑ উফ্!
আঙুল চুইয়ে টুপটাপ রক্তের বৃষ্টিÑ
ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর।
তাইতো! বেসামাল ভুলে বসে আছিÑ
কতোকাল তীরভর্তি তূণীর লুকিয়ে রেখেছি পিঠে,
চোখের আড়ালে; পাছে কাউকে রক্তাক্ত করে ফেলি!

ফিরে আসে শৈশবে হারিয়ে যাওয়া ধনুক
টঙ্কার দিয়ে বলেÑ
‘কতোকাল টানটান; পিপাসার্ত
চেয়ে আছিÑ অঙ্গে জড়িয়ে নে,
তূণীরের একটা তীর খরচ করে দেখ
লক্ষভেদের এই উৎসবে। কথা দিচ্ছিÑ
তোকে আমি ঠকাবো না!’

‘শিরিন, এই শিরিন কি হলো, ভয় পেয়েছিস? আমোদ নিষিদ্ধ ভয়, মৃত্যুর পুতুল জন্ম ।’ ‘প্লিজ, ম্যাডাম আপনি যান। দোহাই আপনার, দরজার সামনে থেকে যান!’ ‘ভয় পাস না বোন। না হয় আমরা অপর। নকল বোন। দরজা খোল।’ ‘আপনার মরা বাপের দোহাই আপনি আমাকে ছেড়ে দেন’ ‘কই যাবি তুই? আমি ছাড়া কে আছে তোর এ ভুবনে, তোকে দেখে শুনে রাখবে কে? এই আমি। পাগলামি করিস না সোনাবোন আমার, লক্ষী বোন দরজাটা খোল। দেখবি আর কোনো ভয় নেই, সব একেকটা মৃত্যুর পুতুল…’

শিরিন ফ্লোর থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে কি কি যেন ভাবে, নিজের উপর রাগ হয়। সে এইখানে আর চাকরী করবে না। পালিয়ে যাবে। কিছুক্ষন পায়চারী ক’রে বাড়ির বাইরের গেট খুলে যেই বের হবে, চমকায় কানামুন্সির চেহারায়। ‘মা জননী, আমি জেনেছি আপনিই উদ্ধারকর্তা। আপনি দস্তখতটা করে দিলেই করিম সাহেবের ইচ্ছাটা পুরণ হয়।’ ততক্ষণে শিরিন মুন্সিকে ঠেলে গেটের বাইরে বের করে দেয়; নিজেও বাইরে এসে দাঁড়ায়। হাত পা নেড়ে নেড়ে দুইজন কথা বলে, ‘আপনার বাবা এই মুখগুলো বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনার উপর দিয়ে গেছেন। আপনি এ কালের মাদার, আপনি তেরেসা, আপনিই নাইটিংগেল।’ একসময় শিরিন ভিতরে চলে আসে। মুন্সি তার পিছন পিছন ঢোকে। ‘আপনার কথা যদি সত্যি হয় আর আমার যদি কিছু করার থাকে আমি অবশ্যই করব। কিন্তু আপনি এখন ম্যাডামকে এ নিয়ে কিছু বলতে পাববেন না।’ ‘আপনি যেভাবে বলবেন। অনন্যা মা ত’ দেখাই দিচ্ছেন না। যেখানে আপনার একটি দস্তখত পিতৃমাতৃহীন এতিম ছেলেপুলেগুলোর সহায় হবে, তাদেরকে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবেনা।’ এতিমখানার পরিচালক মুন্সীজি যদি জানতেন, নিশ্চয় তিনি আসফোস করবেন, বিদ্যালয়ের বইয়ের পাতায় চাপা খেয়ে মরার চেয়ে এই বিশ্বের যে সকল পথ ও মত রয়েছে তাতে পরিভ্রমণ না করে কী ভুলটাইনা করেছেন।

উপরের সিঁড়ি থেকে নেমে আসে অনন্যা। নিচের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে শিরিন। ডাইনিঙ-এর গোল টেবিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় অনন্যা। ‘কিছু বলবি?’ বেশ কিছু সময় অনন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামায়। অনন্যা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ‘কিছু বললে বল।’ সাহস সঞ্চয় করে ভয় তাড়িয়ে শিরিন স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে উঠে। ‘ভেবেছেন কি আপনি? আমি আপনার চাকরি করি বলে আপনি যখন তখন যা খুশি বলবেন!’ উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে শিরিন। যেভাবে কাঁপে কোরবানির জবাই করা পশু। ‘ধমকাবেন, চোখ রাঙাবেন, কিচ্ছু বলি নাই। কেন বলি না। আপনি আমাকে টাকা দেন আর সেই টাকা দিয়ে বাবা মায়ের সংসার চলে। আপনি মনে করেছেন কিছু টাকা দেন বলে আপনি আমাকে, আমার ফ্যামেলির সবাইকে কিনে নিয়েছেন। আরেকজনের মাথাটা শুধু কিনে নেননি, মাথাটা বিগড়েও দিয়েছেন। সে আপনার কৃপাপ্রার্থী! মুন্সিজি’ ‘বাহ্ তোর তো দেখি মুখ ফুটেছে। মুন্সিজি এসেছে? যা, ওনাকে নিয়ে তুই ওপরে আয়।’

শিরিন আর কানামুন্সি দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। অনন্যা মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে তাদের সাথে কথা বলে। ‘মুন্সি বসুন।’ ‘জ্বী মা জননী ধন্যবাদ। আপনার শরীর ভালো?’ ‘আমি যখন বলিÑ আজকে দেখা হবে না তার মানে হচ্ছে- আজকে দেখা করে কোনো ফল হবে না।’ ‘জ্বী মা জননী আমি কিছু মনে করিনি। আমি অপেক্ষা করবো। আপনি যতদিন বলবেন আমি অপেক্ষা করবো।’ ‘আরেকটা ব্যাপার আপনার যেমন এই অর্ফানেজটা নিয়ে একটা ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস আছে এরকম ক্রাইসিস আমার জানা মতে বেশিরভাগ মানুষের বেলায় সত্যি’ ‘কী করব বলুন আমরা বড় দরিদ্র। আপনিতো নিজ চোখে দেখে এলেন। প্রাণের বিকাশ আমরা সকলে চাই। এতিমগুলো একদিন নিজেরা পড়াশোনা ক’রে বড় হবে। মানুষ হবে। অন্য এতিমদের কল্যাণে আসবে। দেশের কল্যাণে আসবে…’ চরকি ক্ষেপে গিয়েছেন। ‘আপনার লেকচারটা একটু বন্ধ করুন। এ বাড়ির বাইরে গিয়ে দেশোদ্ধার করবেন। খালি নিজেরটা… আমারও যে একটা ক্রাইসিস থাকতে পারে সেটা শুনবার মতন সেন্সিবিলিটি আপনাদের গ্রো করেনি, আবার দেশজাতির কল্যাণ!’ ‘লজ্জিত, আমি বড়ই লজ্জিত। এই এতিমদের কথা বারবার বলে আপনাকে বিরক্ত করে যাচ্ছি। আপনার মনোকষ্টের কারণ হয়েছি। কী করব বলুন, আমি নিজে এতিম বলে এতিমদের কথাই শুধু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।’ ‘ইন্টারেস্টিং! আপনি এতিম হলে আমি কী? আমি লিস্ট থেকে বাদ পড়লাম কেনো? আপনার প্রিয়, মরহুম করিম সাহেবের কন্যাকেই বাদ দিয়ে দিলেন! তাকে ছাড়াই দেশে এতিমশুমারী হবে! না না এটা অন্যায়, ভীষণ একচোখা সিদ্ধান্ত!’ মুন্সি বেশ বিব্রত হয়। ‘শিরিন!’ শিরিন চমকে যাবে। মুন্সি আড়চোখে অনন্যার দিকে তাকায়। তারপর চোখ নামিয়ে ফেলে। ‘জ্বি ম্যাডাম!’ ‘তুইও তোর নামটা মুন্সিজি’র রেজিস্টার খাতায় এন্ট্রি করে রাখ।’ ‘মা জননীরা আমি আসলে এভাবে ভেবে দেখিনি।’ ‘ফাইন! যাদের ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার, গাড়ি-বাড়ি রয়েছে তাদের বাবা-মা থাকলেই কী আর না থাকলেই কী, তাই না?’ ‘আসলে হয়েছে কী, আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি। করিম সাহেবের দানের অপেক্ষায় আমরা অনেকদিন অন্যদের কাছে হাত পাতিনি। শিরিন ম্যাডামের সইটা পেলেই ত টাকাটা আমরা পেয়ে যাই। আপনি নিজ চোখেই সবটা দেখে এসেছেন।’ ‘বেশ। আপনার ত শিরিনের সিগনেচার হলেই হয়?’ ‘জ্বী জ্বী । উকিল সাহেব ত বলেই রেখেছেন সইটা হলেই আর কোন সংকট থাকবে না।’ ‘তো আমাদের সংকট হচ্ছে একজন শিরিন খুঁজে বের করা।’ ‘জ্বী জ্বী’ ‘এইযে আপনার পিছনে। শিরিনকে তো আপনি অলরেডি চিনেন। তাহলে আর দেরী কী? আপনার কাগজটা সঙ্গে আছে? শিরিন যা তো একটা কলম…’ ‘কলম আমার সঙ্গেই আছে।’ ‘তাহলে আর সমস্যা কী? শিরিন বস, এই চেয়ারে বস। বসে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে মুন্সিজিকে একটা গভীর সংকট থেকে মুক্তি দিয়ে দে।’ শিরিন বিভ্রান্ত হয়। ‘সী… তুই এখন কত পাওয়ারফুল! ইউ ক্যান বাই ফ্রিডম ফর আদার্স। মুন্সি, তাহলে আর কী! আপনার সমস্যা সল্ভড!’ শিরিন আবারও বিভ্রান্ত। ‘সিগনেচারের আগে কাগজগুলো একবার পরখ করে দেখ শিরিন। তোর করিম আঙ্কেল তোকে এই বিরাট দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।’ কানামুন্সি কাগজ বের করে অনন্যার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে- ‘আমি ত মামনি এখনও কিছু বুঝতে পারছিনা’ ‘শিরিনকে দেন। উইলটা ভাল করে পড়ে নে।’ কানামুন্সির মুখ উজ্জ্বল- ‘তাহলে করিম সাহেব… শিরিন মানে আপনার… আপনি…’ ‘শিরিন ইজ মাই স্লেইভ! মানে চাকর। শিরিন আমি কী ভুল বলেছি? এনি অবজেকশন? মাই ফাদার বট মি অ্যা স্লেইভ। এই শিরিনের মতন আরো কতজনকে উনি এধরনের উইলে সিগনেচার করার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে গেছেন সে ব্যাপারে আমি এখনও ক্লিয়ার নই। তা এইযে আপনি বিভিন্ন জায়গায় লবিং করতে শুরু করলেন এই ব্যাপারটাকে আপনি নিজে কী বলবেন? আমার সার্ভেন্টের সাথে আপনার কন্সপায়রেসি আমি কীভাবে দেখব? এই শিরিন সিগনেচার করে মুন্সিজিকে যেতে দে। ভীষণ জরুরী একটা কাজ সম্পন্ন হবে। আমাদিগের পিতার কলুষিত আত্মা দুগ্ধধৌত হইয়া পবিত্র শুভ্র হইবেক।’

উপর থেকে নিচে নামছে অনন্যা। শিরিন সিঁড়ির কাছে এসে অনন্যার মুখোমুখি। হাত তুলে দুইদিকে দুই হাত প্রসারিত করে শিরিন ম্যাডামকে থামায়। শিরিন উত্তেজনায় একপর্যায়ে নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। পুরো বিষয়টি একটা ভীষণ ঝগড়ায় পরিণত হয়। ‘আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। আমি কী তার উত্তর আপনার কাছে দাবী করতে পারি?’ ‘বা! বা! বাহ্ কী সুন্দর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে শিখেছিস। পারিস! এখন ত পারছিস তবে তার আগে আমাকে বলতে হবে তুই কীসের দাবি নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করার সাহস পেলি?’ ‘আপনি দিয়েছেন। আমার সিগনেচার হঠাৎ এত মূল্যবান হয়ে উঠল কেমন করে? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন।’ ‘ফাইন, নাউ ইউ আর ইন দ্য রাইট ট্র্র্যাক। না আমি তোকে কোন সাহস দিইনি। মরহুম জায়েদুল করিম দিয়েছেন। মানে আমাদের বাবা। মানে আমাদের যিনি এতিম করে রেখে গেছেন।’ ‘আপনি কিন্তু এখনও হেঁয়ালি করে কথা বলছেন।’ ‘বলছি, কারণ আমার মুখটা আরেকটু খুললেÑ ছেমড়ি তুই ওই নর্দমার নোংরার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়বি।’ ‘তবু আমি জানতে চাই। করিম সাহেব আপনার বাবা। আমার জন্য হঠাৎ তার এত প্রেম জেগেছে কেন?’ ‘দায়মোচন।’ ‘কেনো উনি এত দায় নিতে গেলেন? আর আপনারই বা কেন আমার মত একজন সার্ভেন্টকে, একটা স্লেভকে এত টাকা বেতন দিয়ে রাখতে হচ্ছে?’ ‘আমার বেলায় বিষয়টা ছিল পাপমোচন। করিম সাহেব বেঁচে থাকলে তাকে হয়ত প্রশ্নটা করা যেত। এখন তুই তোর মাকে গিয়ে সেম প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে পারিস।’ ‘আচ্ছা। ম্যাডাম এই কয়দিনে অন্তত আমি একটা জিনিষ আন্দাজ করতে পেরেছি আপনি সত্যিই আপনার বাবার মতো।’ ‘কী বলতে চাস তুই?’ ‘আপনারা দুইজনেই এক্সপ্লয়টার। সিক্, মেন্টালি সিক। অন্যকে লো’ করে মেন্টালি ডেস্ট্রয় করতে পারলে আপনার শান্তি হয়। আপনি আমাকে বলেন, আমার মাকে জিজ্ঞেস করতে? হ্যা, আমার মা’কে? হারামী! তুই তোর মরা বাপকে কবর থেকে টেনে বের করে জিজ্ঞেস কর… প্রিম্যাচিউর মেইড সার্ভেন্টের সাথে সেক্স করে সে কী আনন্দ পেয়েছে!’ শিরিন নিজে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত অনন্যার দিকে তাকিয়ে কাঁপতে থাকে। শিরিনের এই দশা দেখে হাততালি দিয়ে খুশি হওয়ার ভঙ্গিতে কথা বলে চরকি। যেন সে এই মুহূর্তের জন্যেই অপেক্ষা করেছে অনেক দিন। ‘একজন জারজের মুখেই এরকম কথা শুনতে পাব, আমি মোটেও অবাক হইনি তোর আচরণে!’ শিরিনের উত্তেজনার কাঁপুনি ধীরে ধীরে কান্নায় রূপ নিচ্ছে। ‘আর তাই এখন বাবার মতন, বাবার কাজটুকুন করে যাচ্ছেন! সুযোগ্য কন্যা। আমার মালকিন। সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি নেবার মতন অনেস্টি যার নাই, ছিলনা কোনদিন, সে মরার আগে অর্ফানেজের জন্যে ডোনেশন দিয়ে গেছে।’ ‘এটাতো তোকে দিয়ে গেছে। রাগ করছিস ক্যান?’ ‘আর আপনার মতন উঁচু গলার নিচু কন্যাকে দিয়ে গেছেন বাবার কুকর্ম ঢাকার এখতিয়ার। এটাইতো আপনার পাপমোচন?’ ‘রাইট ইউ আর! সেই সঙ্গে আছে বাড়তি দায়িত্বÑ পাপের ফসলের দেখভাল করা!…হা. হা. হা.’ ‘এহ্, পাপমোচন করে যাচ্ছে না নিত্যপাপচর্চা! আমি জানি না আমার ঘরে রাতের বেলা কে আসে। কোন গোপন ইচ্ছায়? ভ্যাম্পায়ার! রাতের অন্ধকারে আসে রক্তচোষা। বিকারগ্রস্ত গণ্যমাণ্য ধনীর দুলালী। যিনি নাকি আবার একজন আর্টিস্ট। হ্যাহ্ আর্টিস্ট! কথায় কথায় স্লেভ! আর্টিস্ট না ফিউডালিস্ট? সারা দুনিয়া ঘুরে ম্যাডাম আমার জায়গা নিয়েছেন সেই মধ্যযুগে। কথায় কথায় শুধু স্লেভ, মাই ফাদার বট মি আ স্লেইভ! রাবিশ! একেবারে ঘেন্না ধরে গেছে!’ ‘এন্ড দ্যাট ভেরি স্লেইভ ক্যান বাই ফ্রিডম ফর আদার্স! গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট!’ ‘আর আপনার অ্যাচিভমেন্ট হলো, অ্যাওয়ার্ড হলো মৃত্যুর পুতলা। এমন ফেইক মডার্ন আর্টিস্টের কাছে প্রিয় পেইন্টিং হল চাবুকের আঘাতে জীর্ণ মানুষের রক্তাক্ত জামা। প্রিয় সঙ্গীত ওই বান্দাদের যে অলংকার পরিয়েছেনÑ সেইসব শিকলের ঝনঝন শব্দ, সাথে শপাৎ শপাং ভয়ার্তের আর্তনাদ, দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস হৃদপিন্ডে, ঝড়ের সমুদ্রে ফুসে উঠা ঢেউয়ের ওঠানামার সিম্ফনি। ওয়াইনের গ্লাস হাতে কী মিষ্টি করে হিউম্যানিটির কথা, নেচারের কথা, গ্লোবাল ওয়ার্মিংএর কথা বলেন! ইনার ফ্রিডমের কথা! ইউ আর আ টোটাল ব্লান্ডার। ইউ আর নাথিং, নট এন আর্টিস্ট।’ ‘এনাফ! হাউ ডেয়ার, ইউ এস্টিমেট মি!…য়্যূ আনকলচরড বাফুন…বান্দী! তুই বান্দী তোর মা বান্দী তোর চোদ্দগুষ্টি বান্দী। তুই হলি আমার বাবার বাদীচোদা মেয়ে বুঝলি!’ ‘বা- বা - বা। বাবার সুযোগ্য কন্যাকে এবার মিষ্টি ক’রে বাংলায় একটা কথা বলি? আমি নিশ্চিত, শতভাগ নিশ্চিত আপনি করিম সাহেবেরই কন্যাÑ আমার ম্যাডাম, আমার জারজ বোন। একজন জারজের বোন হলে তাকে জারজ বোন বলেই ত ডাকবো তাই না? অনন্যা কে? অনন্যা আমার জারজ বাবার কন্যা, আমার জারজ বোন! ব্যাপারটা পছন্দ হলো?’ ‘ইউ বাস্টার্ড, নাও আ’ম গোয়িং টু কিল ইউ।’ চরকি শিরিনের চুলমুঠি ধরে। তারপর রান্নাঘরের দিকে যায় ছুরি আনতে। এই সুযোগে শিরিন তার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। শিরিন বিছানায় শুয়ে কাঁতরায়। একসময় চরকির দরজা ধাক্কানোয় সে রীতিময় ভয় পেয়ে যায়। বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করে। চরকির ছুরির শব্দ তাকে পাগল করে দেয়। এক পর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।

শিরিনের মাথার পাশে বসে ছুরি দিয়ে আপেল কাটছে চরকি। কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে আছে অ্যারন । অ্যারনকেও ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। একটা আপেলের টুকরা এগিয়ে দেয় অ্যারনকে। অ্যারন চরকির বন্ধু, আবার শিরিনের দিকেও তার একটু সফট্কর্নার তৈরি হয়ে থাকবে। অ্যারনও বিদেশে ছিল দীর্ঘদিন, এসেছে ডিভোর্সী স্ত্রীর কাছে থাকা কন্যাকে মাঝেমধ্যে দেখতে পাবে বলে। কিন্তু সে বেচারীও বিরক্ত হয়ে নতুন স্বামীটিকে নিয়ে দেশে এসেছিল অ্যারনের হাত থেকে রেহাই পেতে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে স্বামী আর কন্যাকে নিয়ে এবার চলে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। যাতে অ্যারনের দেখাছোঁয়ার বাইরে গিয়ে কন্যাকে মানুষ করতে পারে। ঘুমন্ত শিরিনের পাশে দুই বন্ধুর কথোপকথন চলে, অ্যারনের হতচকিত চেহারা দেখে চরকিই কথার চাবি ঘুরায়Ñ ‘তুমি শক্ড?’ ‘আম’ নট শ্যূর। আফটার নোয়িং অল দিস, শি মে গন ক্রেজি। তুমি নিজে ত আগে জানতে?’ ‘মুন্সি আসার পর থেকে। হোয়াই শিরিন! দেন আই স্টার্টেট টু এক্সপ্লোর। আই হ্যাভ গন থ্রু অল দ্য পেপারস উইথ দ্য অ্যাসিস্ট্যা›স অব মাই ল’ইয়ার।’ ‘তুমি আবিষ্কার করলা, শি ইজ য়্যুর সিস্টার!’ ‘স্টেপ সিস্টার! দ্যাট ব্লাডি ফাকিং বাস্টার্ড ডিডন্ট কেয়ার আব্যাউট এনিথিং। শেম্ অন মি! আই হ্যাড টু প্রিপেয়ার হার টু টেল উইথ ভেরি টাইনি ডিটেইলস্…’ ‘বোথ অব য়্যু নিড সাম মোর টাইম টু ফেস দিস কাইন্ডা কমপ্লেক্স ট্রুথ।’ ‘এন্ড দ্য ট্রুথ ইজ, আই স্টিল ক্যান্ট বিলিভ, হাউ হি কুড ডু দিস টু হার, হার প্যারেন্টস! ব্লাডি ফুল, হি জাস্ট ওয়ান্টেড টু রেস্ক্যু হিমসেল্ফ ইন দ্য নেম অব সোশাল প্রাইড হি জাস্ট রূইনড্ শিরিনস্ চাইল্ডহুড… হোল লাইফ, আই হোপ শি উইল ম্যানেজ। ইভেন আফটার ডেথ্ জাহেদ করিম প্রুভড হিমসেল্ফ এ্যাজ অ্যা নোব’ল ম্যান! বুঝতে পারছো? আমি ক্যানো এতো অস্থির হয়ে আছি? কতোদিন ধরে, নিজের কাজকর্ম্ম সব ফেলে এখানে বসে বাবার নোংরা পরিস্কার করছি?’ ‘ওর বাবা-মা ত ব্যাপারটা জানতেন?’ ‘জানতেন। লোভ। আই গেজ, মাই গ্রেট ফাদার বট দেম অল। নাউ দে আর গেটিং রিওয়ার্ডস। অন্য অনেক কিছুর মতো এই বাড়িটাও শিরিনের নামে।’ ‘আই হোপ, য়্যু আর নট কিডিং উইথ মি!’ ‘ভালই হলো। তুমি শিরিনকে পছন্দ করো। এ দেশেই থাকতে চাও। তুমি আর শিরিন থাকবে…এন্ড ইফ ইউ গাইজ ওয়ান্ট মী টু অ্যাক্ট লাইক শিরিন। আম হিয়ার… হা.হা.হা.’ চরকি শিরিনের মাথায় হাত বুলায়। শিরিন একটু নড়ে চড়ে ওঠে। শিরিন চোখ খোলে, অনন্যা করিমকে দেখে ভয়ে ভ্রƒ-কুঁচকায়। অ্যারনও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। একটু বিভ্রান্ত, ‘অ্যারন ভাই! ম্যাডাম! আমি কি মারা যাচ্ছি…খালি ডুবে যাচ্ছি রক্তের ভিতর, ভেসে উঠি ফের ডুবে যেতে। রক্তের সমুদ্র… আমি কী মরে গেছি নাকি?’ ‘ঘুম থেকে উঠে তুমি দেখবে আবার জন্ম হয়েছে। ঘুম হলো একখন্ড মৃত্যুর নাম। জেগে ওঠা মানেই ত পুনর্জন্ম। পুনর্জন্মে আবার দেখা হবে। এখন একটু ঘুমাও।’ অ্যারণের কথা শুনতে শুনতে আবার গভীর ঘুমে ঢলে পরে শিরিন। অনন্যা তার মাথায় বিলি কেটে দেন। ‘বেচারা। কতোকাল ধরে, এই প্রশ্নগুলো বারবার তার মনে উঁকি দিয়ে লুকিয়ে গেছে। সঙ্কোচ ভয়।’ ‘ডক্টর ত বললেন, রাতে আর সমস্যা হবার সম্ভাবনা কম। আর শোনো যে কারণে দেশে, সে কারণটা আজ রাত চারটা বিশের ফ্লাইটে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ ‘ও তোমার কন্যা তার মা ওরা আবার ফিরে যাচেছ?’ ‘অনেক মূল্য দিয়ে একটি প্রদর্শনীর টিকিট কিনেছি।’ ‘সেটা আবার কী?’ ‘আমৃত্যু আজীবন দেখা করতে না চাওয়ার বিনিময়ে কন্যাদর্শন। পিতা-পুত্রীর বিদায় বেলা। লাস্ট টেন মিনিটস এর এক ন্যানোসেকেন্ডও আমি হারাতে চাইনা। চোখকে রিকোয়েস্ট করে বলেছি এই দশটা মিনিট অপলক তাকিয়ে থাক আমি তোকে চিরকালের জন্যে ছুটি মঞ্জুর করবো।’ কান্না গলে পড়বার আগেই ছুটতে হয়, সময়ের নানা ছুতায়।

কথা, থাক; থাক, বাকি কথা।

দুইবোন পরস্পর জড়িয়ে ঘুমায়। শিরিনের ঘুম ভেঙেছে, সে একটু নড়াচড়ার চেষ্টায় চরকির বাহুবন্ধন টের পায়। কিন্তু চরকির মুখ এতো কাছ থেকে দেখে, ভয়ে চমকায় না। বরং বেচারীর মুখটা তার কেমন দিদাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কড়া মেজাজী মানুষও সামান্য বিশ্রামের কাছে শিশুর মতোই অসহায়। আঁখিপল্লবে ক্লান্তি এলে কী করে ঠেকাবে তারে! এইসব কথা মনে এনে শিরিন অনেক সাবধানে চরকির হাতটা সরিয়ে নিজেকে আলগা করে পাছে বোনের ঘুম না ভাঙে। জমজবোনের মতো জারজবোন শব্দটা মাথায় এসেছিল মনে পড়ায় শিরিনের ঠোঁট আলতো ফাঁক হয়। রাত্রির গর্ভে জন্ম নেয় দিন, দিনকে গিলে খায় রাত। ফের সূর্যালোকের মতো সত্য, সত্য-মিথ্যা, ভেদ-বিভেদ নিয়ে দিনের আতুড়ঘরে আমাদেরও পুনর্জন্ম হয় মৃত্যুর গর্ভে। ভয়ের গর্ভে। গভীর আমোদ। এই আমাদের পুতুলজন্ম।
শিরিন আলগোছে খাটের প্রান্তে গিয়ে বসে আড়মোড়া ভাঙে। জানালার পাশের ডালিম গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখে কয়েকটি পাখি কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার বিষয় বোধ হয় ফড়িং শিকার। ঠিক শিকার নয়, খাবার বন্টন। শিরিন হালকা শীত অনুভব করে। শরীরে গতকাল আজ হয়ে দৌড়ঝাপের ব্যথা তিরতির ক’রে ফিরে আসছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। না স্বপ্নের ঘোর নয়, শুধু কিছুটা ভূত আর ভবিষ্যতের খুঁটিতে ঝুলানো মাদারীর দড়িতে কাঁপতে থাকা আমোদ, আঁশ; যাকে বতর্মান বলে ডাকাডাকি করা যায় কিন্তু দু’দন্ড আলাপের অবসর কই? পা’ঝুলিয়ে ব’সে আস্তে আস্তে এইসব দোলা আসে মনে…

‘জ্বর, এক প্রেয়সীর নাম
চায়নি ত কিছু;
শুধুই জড়িয়ে থাকা, সবটা জুড়ে।
তবু কেন তাকে সারাতে চাও?
ডাক্তারবদ্যিপ্যারাসিটামলজলচিকিৎসাকতোকি
এতো অপমানেও সে ছেড়ে যায়না ত! …’