‘আপনাকে বিদায় নয়, স্বাগতম’

হক ভাইয়ের সাথে আমার অনেক স্মৃতি এবং সেসব স্মৃতি যে খুব মধুর তা নয়, তবে সবটা অমধুরও নয়। সেসব স্মৃতি দু একটি বলার আগে আমরা তার লেখক সত্তায় কীভাবে কতটা আপ্লুত হয়েছিলাম সেই দিকটা আগে জানানো উচিৎ।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2016, 06:02 PM
Updated : 27 Sept 2016, 06:02 PM

আমরা যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করছি তখন তিনি কিংবদন্তি লেখক। লেখার জন্য যেমন, তেমনি তার জীবনাচরণ সম্পর্কে নানান গল্পের জন্যও। শুনতাম তিনি মধুসূদনের মতো একসঙ্গে একাধিক লেখা লেখেন। হাতে লেখার যুগে তিনি লেখেন টাইপরাইটারে। তারপর তিনি নাকি অত্যন্ত নাগরিক ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত, অনেকটা বিদেশি লেখকদের মতো। তার চেয়েও বড় কথা তিনি এক হাতে নাটক, অন্য হাতে উপন্যাস, আরেক হাতে গল্প, অন্য আরেক হাতে কবিতা- এ রকম আরও অনেক কিছুই আমরা শুনতাম।

হয়তো এর মধ্যে অতিরঞ্জন ছিল, কিংবদন্তি হলেই তার মধ্যে অত্যুক্তি থাকবেই। কিন্তু অতিরঞ্জন আছে কি নেই, তা নিয়ে তখন আমাদের কোনো তদন্তবোধ কাজ করেনি সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য। আর ততোদিনে তার ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়ে আছি। তার গল্পও আমাদের একই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ পড়েও দারুণ উদ্দীপ্ত।

এছাড়া তার ‘পরানের গহীন ভিতর’ও কম আচ্ছন্ন করেনি কথ্যভাষার এমন সফল ও কাব্যিক ব্যবহারে। নাটকতো আছেই। আরও একটি ব্যাপার হলো- তারই অনুবাদে সল বোলের শ্রাবণরাজাও ততোদিনে পড়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ একজন লেখক সাহিত্যের এতো সব শাখায় লিখছেন তাকে কোনোভাবেই সাধারণ ভাবা সম্ভব নয়।

আরও জানা গেল তিনি নাকি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও গানও লেখেন। অর্থাৎ সব্যসাচী লেখক বলতে যা বোঝায় তার সব বৈশিষ্ট্যই আছে বলেই আমরা তথন এই একমাত্র সৈয়দ শামসুল হককেই বুঝতাম। এই জানাটা আমাদের জন্য তখন ছিল দারুণ উদ্দীপনাময়। মনে মনে আমরা তাকে আদর্শই করে নিয়েছিলাম। তার সম্পর্কে আমাদের মনে এই ভাবমূর্তির পরপরই বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় যখন তার উপন্যাসগুলো বেরোতো সেগুলো না পড়ে কোনো উপায় ছিল না।

স্পষ্ট মনে আছে- অন্তর্গত, মহাশূন্যে পরান মাস্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী। দ্বিতীয় দিনের কাহিনী বইটি যখন গ্রন্থাকারে বেরোল তখন এর আকৃতি, অঙ্গ সৌষ্ঠব, আর সর্বোপরি লেখার নিজস্ব শৈলীর জন্য তার কিংবদন্তির ধারণাটি আমাদের মধ্যে জনশ্রুতি থেকে বিশ্বাসে ন্যস্ত হয়ে গেছে। এই বিশ্বাসের কারণে তাকে দেখার আকর্ষণ তীব্র হয়ে ওঠে, কিন্তু শুনেছি তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্বপ্রখর মানুষ। সুতরাং তার সাথে দেখা করাটা আমার জন্য অতি দুঃসাহস বলে মনে হত। আমি একটু স্বভাবভীরু বলে তাই বহু বছর যাবৎ তার সামনে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করিনি। তবে দূর থেকে দেখেছি দু একবার একুশের বইমেলায়। সেই দেখাও ছিল মনে রাখার মতো।

যা শুনেছি তার সঙ্গে এই দেখার একটা ফল হল, এই যে তিনি দুর্ভেদ্য ধরনের লোক, তার সামনে গেলে তিনি অবলীলায় যে কাউকে, অন্তত আমার মতো উপাধিবিহীন ছোকরাকে কয়েক কথার ঘায়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলতে পারেন। অতএব তার কাছ থেকে আমি নিরাপদ দূরত্বেই থেকেছি বহু বছর।

কিন্তু দূর থেকে তার লেখার সান্নিধ্য নিয়েছি নিয়মিত। তার প্রথমদিকের কয়েকটি লেখা যেগুলো তখন দুষ্প্রাপ্য ছিল, যেমন রক্তগোলাপ, তাস, কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন- এগুলো পড়ে আমার মনে হয় কথাসাহিত্যে তিনি তুলনাহীন। তার সমসাময়িকদের তুলনায় তার ভাষা ও বয়ানশৈলী খুব আলাদা।

তার নেপেন দারোগার দায়ভার পড়ে মনে হলো তিনি গল্পের এক যাদুকর। এই গল্পের এক জায়গায় তিনি বলেছেন ‘মৃতেরাও জীবিতের জন্য অপেক্ষা করে’। চমকে উঠেছিলাম এই বাক্যটি পড়ে, কী ধরনের যাদুকরী শক্তি থাকলে পুরো বিষয়টাকে তিনি উল্টে দিতে পারেন। বাক্যটা বলার জন্য এবং বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য পুরো গল্পে তিনি এমন সফল ও শৈল্পিক দক্ষতায় বিষয়টি এনেছেন যে, রীতিমত অবিশ্বাস্য মনে হয়। হক ভাই এসব মুগ্ধতার কথা জানতেন না। কারণ তার সাথে আমার দেখা হয়নি তখন। অথচ এসব মুগ্ধতার কথা তাকে জানাতে ইচ্ছে করতো।

অবশেষে তাকে সেসব মুগ্ধতার কথা জানাবার সুযোগ এলো তার একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ে। একটি নয়, তার দুটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার, একটি কবি ব্রাত্য রাইসুসহ, আর অন্যটি একাকী। দ্বিতীয় অর্থাৎ একাকী যেটা নিয়েছিলাম সেটা বেশ ভুগিয়েছিল আমাকে।

১৯৯৫/৯৬ সালে তার সেই সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বেশ রোষাণলে পড়েছিলাম। তার জন্য অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন করায় তিনি খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। পারলে তিনি আমাকে তখনই ‘চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন’। আমাদের বান্ধবী সেলিনা শিরিন সিকদার সেই দৃশ্যের দুর্লভ সাক্ষী। তিনি এতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন যে, বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, “বন্ধ কর রেকর্ডার।” রাগে ক্রোধে তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “তুমি জান কী বলছ? আমাকে তুমি আসামি পেয়েছ? আমি কি আদালতে জবাবদিহি করছি?” ইত্যাদি ইত্যাদি। তার নেওয়া সেই সাক্ষাৎকার হুবহু প্রকাশ করা হয়েছিল সে সময়।

এই ঘটনার আগে পরে বহুবার দেখা হয়েছে তার সঙ্গে। আমার প্রায় ভঙ্গুর ও স্পর্শকাতর ব্যক্তিত্বের পক্ষে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া বিপজ্জনক মনে হতো সব সময়। ফলে তার সাথে সৌজন্যমূলক যোগাযোগের বাইরে ঘনিষ্ঠতা বলতে গেলে হয়নি।

তবে ২০১০ সালে দেশের ফেরার পর সেই দৃশ্য অনেকটা পাল্টে যায়। ফোন করে তার সাথে দেখা করতে চাইতেই হক ভাই আমাকে সপরিবারে নৈশভোজের দাওয়াত দিলেন তার বাসায়। বললেন, “অবশ্যই বউ বাচ্চা নিয়ে আসবে।” বললেন এমনভাবে যেন মেহমানকে দাওয়াত নয়, আদেশ দিচ্ছেন। আমি ঘাবড়ে গিয়ে সেই আদেশ পালন করতে বাধ্য হই। তার সেই দাওয়াতে সেদিন কেবল সম্মানিতই বোধ করিনি, রীতিমত অবাকই হয়েছিলাম আমি। হক ভাই দাওয়াত দিচ্ছেন তার বাসায় আমার মতো নামহীন গোত্রহীন একজনকে? বিশ্বাস করা যায়? সেদিন অনেক মজার মজার খাবার খাইয়েছিলেন আমাদের। ড্রয়িং রুম থেকে আমাদের দোতলায় তার লেখার রুমে নিয়ে গেলেন। জানি না এমনটা তিনি অন্য অনুজদের ক্ষেত্রেও করেছেন কি না। কে না জানেন, হক ভাইয়ের শিলাদৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে আমরা ছিলাম নিতান্তই লতাপাতার মতোই। ফলে সেদিনের সেই সৌজন্য ও ঔদার্য ছিল অভাবনীয়।

হক ভাই এবং আনোয়ারা আপার সাথে সেদিন আমাদের আত্মিক নৈকট্য নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আমার ছেলের সাথে সেদিন খুব আদর করে অনেক কথাবার্তাও বললেন। ভোজ শেষে আমাদের ড্রাইভার দিয়ে বাসায়ও পৌঁছে দিয়েছিলেন। এই হক ভাইকে আমার কোনদিনই চেনা হতো না যদি না দেশে ফিরতাম। এর পরে হক ভাইয়ের এই আন্তরিকতার টানে বহুবার গেছি তার বাসায় । একবার কি দুবার তার জন্মদিনে শুভেচ্ছাও জানাতে গেছি। কিন্তু হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম, হক ভাই আমার ফোন কল আর রিসিভ করছেন না। ঘটনাটা অনুমান করে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলাম, ফলে নিশ্চিত নই সেই অনুমান আদৌ সত্য কি না।

ঘটনা হলো বছর দেড় দুই আগে ফেইসবুকে তার সাথে হুমায়ুন আহমেদের অর্জনের একটা তুলনা করে পোস্ট দিয়েছিলাম। খুব সম্ভবত সেটা কেউ তাকে অবগত করে থাকতে পারেন। এছাড়া তো হক ভাইয়ের সাথে আমার হৃদ্যতা ছাড়া বেয়াদবির কোনো ঘটনা ঘটেনি। নিশ্চয়ই তিনি সেই পোস্টে ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর তার সাথে দুবার দেখাও হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে; তিনি শীতল ও উদাসীন আমার প্রতি। এরপর আমিও আর যেচে গিয়ে ভুল ভাঙাবার কোনো চেষ্টা করিনি।

এখন যেচে গিয়ে সেই ভুল ভাঙানোর সুযোগ আর নেই। মাত্র তিনদিন আগেই হক ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কের এই সব অম্লমধুর বিষয় নিয়ে ফেইসবুকে লিখেছিলাম। সেখানে তার সাথে সপরিবারে কয়েকটি ছবি আপলোড করে এও বলেছিলাম: “হক ভাইকে শুভেচ্ছার সূত্রে আজ এগুলোকে প্রাকাশ্যে আনার একটা সুযোগ পেলাম। ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম থেকে এই ছবিগুলো যেভাবে জাগ্রত হলো, আপনিও, হক ভাই, ব্যাধিকে শয্যায় রেখে আমাদের ভালোবাসার কাঁধে হাত রেখে আরও কিছু দূর জীবনের দিকে হাঁটতে আসুন। হক ভাই এখন অসুস্থ। আমি চাই তিনি শিগগিরই ডাক্তারের ভবিষ্যৎবাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে দীর্ঘায়ু নিয়ে ফিরে আসবেন হাসপাতালের শয্যা থেকে।”

কিন্তু হক ভাই আমাদের এই শুভেচ্ছা উপেক্ষা করে চলে গেলেন আজই। আমি জানি এই চলে যাওয়া, অন্তত প্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে, ফিরে আসার সূচনামাত্র। তিনি এখন তার সৃষ্টিকর্মের সমগ্র ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। কিংবদন্তির বীজ থেকে এখন জন্ম নেবেন অন্য এক সৈয়দ হক, ‍যিনি অনঙ্গ হয়েও আমাদের ভাষা ও ঐতিহ্যের প্রাণবন্ত উপস্থিতি হিসেবে আমাদের সঙ্গ দেবেন। আপনাকে বিদায় নয়, স্বাগতম।

লেখক: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহকারী সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক