ভি তো আমরা দেখাবো ওয়ামি, তোমরা না

বাংলা ব্লগে হাতেখড়ি নিয়েছিলাম কবিতা লিখতে। কিন্তু হয়ে গেলাম মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধী বিষয়ক লেখক। এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয় কামারুজ্জামানকে।

অমি রহমান পিয়ালবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 April 2015, 05:06 PM
Updated : 13 April 2015, 06:12 AM

একাত্তরের ঘৃণ্য খুনী বাহিনী আলবদরের প্রধান সমন্বয়কারী যেসব উত্তরসূরী রেখে যাচ্ছে তারা বাংলা ব্লগিংয়ের উষাকালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে নোংরামীগুলো করেছে তা পড়ার পর তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসেনি আমার। শুরু করেছিলো তার মেয়ে মলি। ‘যুদ্ধাপরাধের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার হওয়া উচিত’- এই শিরোনামে একটা ব্লগ পোস্ট করে স্রেফ মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার দ্বিতীয় পোস্টটিই ছিলো ‘রাজাকার, জামাত এবং ইত্যাদি’ ওই মলিকে উদ্দেশ্য করেই।

তবে সে থেমে থাকেনি। অন্য নামে ব্লগিং শুরু করার আগে বরং নিজের বাবা এবং চাচাকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সে লেখে ‘তাহলে আমিও রাজাকার’ নামে একটি ব্লগ। এবং ওয়ালীকে রাজাকারপুত্র বলে সম্বোধন করায় তার প্রতিবাদে লেখে, ‘মেরুদণ্ডহীন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি খোলা পোস্ট।এই ওয়ালী তার ভাই। কামারুজ্জামানের পুত্র। এবং আরেক ভাই ওয়ামী। তারা শুধু স্বনামেই নয়, ভূত এবং দাদাভাই নামে দুটো নিক নিয়েও ব্লগিং করতো। মূলত সেগুলোতে তারা পোস্ট করতো না, মন্তব্য করতো বিশ্রী এবং আক্রমণাত্মক ভাষায়। তিন ভাই বোনেরই কমন শত্রুতা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত ব্লগারদের সঙ্গে।

প্রথম বাংলা ব্লগ সামহোয়ার ইন ব্লগ ডট নেটে তাদের এই বেপরোয়া তাণ্ডব চালানোর নেপথ্যের জোরটা সম্পর্কে একটু পরে বলছি। তার আগে জানিয়ে দেই শুধু কামারুজ্জামানের পোষ্যরাই নয়, শুরুর সেই প্লাটফর্মটা দখলে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো জামায়াতের বিভিন্ন নেতার পুত্রকন্যা, জামায়াত শিবিরের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবি এবং লেখকরা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো সৌদি প্রবাসী উটু ফজল, ছাগুচীফ খ্যাত ত্রিভুজ, রেডিও তেহরানের আশরাফ চৌধুরী, ফ্রান্স প্রবাসী শাওন, কানাডার বুড়ো শাহরিয়ার, অস্ট্রেলিয়ার আস্তমেয়ে, চতুর্ভুজ, ফারজানা মাহবুবা, দুবাইর আতর ব্যবসায়ী সারওয়ার চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা বিতর্কিত লেখা লেখতো তারা। জাতীয় সঙ্গীত হিন্দু কবির লেখা, এটা বদলানো উচিত, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা মোটেও ত্রিশ লাখ নয়, বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে ইত্যাদি গা জ্বলানো পোস্টের পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে বিশেষ করে মওদুদীবাদের প্রচারণা চালাতো তারা। কথিত আছে,সামহোয়ার ইন ব্লগ এর অংশীদারিত্ব ছিলো কামারুজ্জামানের। সামহোয়ারের ডিরেক্টরিয়াল বোর্ড মিটিংয়ের একটি ছবিতে ওয়ালী ও ওয়ামীর উপস্থিতিতে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। মালিকানার জোরেই তারা শুরু করেছিলো তাদের যথেচ্ছাচার।

আজ  প্রতিক্রিয়াশীল উগ্রপন্থীদের হাতে মুক্তমনারা যে মরণঘাতি আক্রমণের শিকার, তার তাত্ত্বিক হিসেবে অনায়াসেই উপস্থাপন করা যায় ওয়ালীকে। ২০০৬ সালের ২৮ মার্চ আস্তমেয়ের লেখা একটি পোস্টে তার কমেন্টটা হুবহু তুলে দিচ্ছি: "আসলে আমরা যারা "প্রগতিশীল" এবং "মুক্তমনাদের" ভণ্ডামীগুলো ধরতে পেরেছি তাদের উচিত এক হয়ে এদের আলু ভর্তা বানানো এবং সাথে শুকনো মরিচ দিয়ে খাওয়া। তবে দুটি পদ্ধতিই খোলা রাখতে হবে। ইন্টালেকচুয়েলি এবং ফিজিক্যালি। ইন্টাল্যাকচুয়েলি কিভাবে এদের আলুভর্তা বানানো যায় সেদিকটা আপনি দেখতে পারেন বা ভাবতে পারেন। আমি বলছি ফিজিক্যালি এদের কিভাবে আলু ভর্তা বানানো যায়। সব সময় একটা বেসবল ব্যাট হাতের কাছে রাখতে হবে। রাস্তা, মেট্রো, বাস, ট্রাম যেখানেই এদের দেখা যাবে তাদেরকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরুদণ্ড বরাবর একটা আঘাত করতে হবে যাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরা সোজা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কাজটা করতে হবে খুব সাবধানে এবং যার যার সামার্থ্য অনুযায়ী এবং একাজে যারা খুব পারদর্শী তাদেরই অগ্রগামী হওয়া দরকার। কারন ধরা খাইলে জামিন নাই। আরো প্রতিবাদ করা যায় যেমন এদের সাথে কোথাও দেখা হলে তাদের মুখ বরাবর থুথু দেয়া যেতে পারে। আরো করা যেতে পায়ের চটি খুলে ছুঁড়ে মারতে পারেন কেউ কেউ অবশ্য চটির দাম যদি বেশী হয়ে থাকে তাহলে থুথুই যথেষ্ঠ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ফিজিক্যাল এসল্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াহ। গণপিটুনি আরো ভালো। যে মাইর ডিজার্ভ করে তাকে তো মাইর দেয়াই উচিত, নাকি?"

এই সরাসরি শারীরিক আক্রমণের হুমকিটা ব্লগাররা ভালোভাবে নেয়নি। এরপর শুরু হয়েছিলো বেসবল ব্যাটের ছবি সহযোগে সবার রম্য পোস্ট। মোটামুটি কোণঠাসা অবস্থাতেই এরপর মলি নিজ নামে ব্লগিং বন্ধ করে দেয়। ওয়ালী আর ওয়ামী হয়ে যায় অনিয়মিত। দু বছর পর আবার স্বাধীনতার মাস মার্চেই বাংলা ব্লগে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটা ঘটায় কামারুজামানের বড় ছেলে ওয়ামী।২০০৮ সালের ১৪ মার্চ প্রেসক্লাবে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কামারুজ্জামানকে দেখে ধাওয়া দিয়েছিলো।  ওয়ামী সে রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কুকুর সম্বোধন করে পোস্ট দেয়। এবং প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানায় তার বাবাকে পারলে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ঝোলাতে। ব্লগার মুকুলের লেখা ‘সামহোয়্যারের ব্লগার বন্ধুরা...এই কথাগুলো শুনুন...এই কলংক যেন আমাদের স্পর্শ না করে...’ শিরোনামে পোস্টটির মাধ্যমে ফুসে ওঠে বাংলা ব্লগ।

তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, দাবি ওঠে ওয়ামীকে চিরতরে নিষিদ্ধ করার।এ দাবি মানতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। তবে তার আগে ব্লগে ব্লগে পোস্টে পোস্টে ওয়ামী ধৃষ্টতার সঙ্গে জানান দেয় তার মন্তব্য সে পরিহার করবে না।

দিনদুয়েক আগে ফেসবুকে ব্লগার আরিফ জেবতিক লিখেছেন: কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার এই মুহুর্তটি বাংলাদেশি ব্লগারদের কাছে অন্য রাজাকারদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার চাইতে ভিন্নতর।

বাংলা ব্লগে কামারুজ্জামানের দুই ছেলে ওয়ালি এবং ওয়ামির ক্রমাগত উস্কানিমূলক আচরণ নেট জগতে রাজাকারের বিচারের দাবিকে তীব্রতর করে তুলে। এই দুইজন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বেসবল দিয়ে পেটাতে হবে জাতীয় হুমকি দিত বা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অশ্লীল গালাগালি করতে পছন্দ করত। তাদের এই উদ্ধত আচরণের বিপরীতে বাংলা ব্লগাররা ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্মের পক্ষে লেখালেখির স্পেস দখল করে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের জনমত গঠনে কাজ হয় এবং বাকিটা তো ইতিহাস...। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার কৃতিত্ব অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারের, আন্দোলন ও জনমত গঠনে অনেকগুলো বড় বড় পক্ষের, তবে বাংলা ব্লগের যদি এক চিমটি অবদানও থাকে, সেই অবদানে আমরাও অংশীদার।

কামারুজ্জামানের এই রায় কার্যকর করার মুহুর্তে আমি স্মরণ করছি সেকালে সেই সহযোদ্ধাদের, যাদের অনেকেই হয়তো আর ব্লগ জগতে এখন নেই কিংবা থাকলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, নিজেদের মধ্যে মারামারি গালাগালিতে ব্যস্ত আছেন; কিন্তু এদের প্রত্যেকের রাতের পর রাত ঘুমহীন পরিশ্রম, দিনের পর দিন ধৈর্য ও ক্রোধের সমন্বয় সবকিছু আজকের এই দিনে বড্ড মনে পড়ছে।

আমরা এই দিনটি অবশেষে দেখে যেতে পারছি-আমরা গন্তব্যের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে আছি,

এই মুহুর্তে আমি আপনাদের প্রত্যেকের জন্য পরম মঙ্গল কামনা করছি।

আমাদের যৌবনের মুহুর্তগুলো অনর্থক যায়নি, এই অর্জনগুলো দেখে ভালো লাগছে।

আপনারা যে যেখানে আছেন, ভালো থাকুন।’

দীর্ঘ সাত বছর পর ফাসির অপেক্ষায় থাকা যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের সঙ্গে শেষ দেখা করতে এসে ‘ভি’ চিহ্ন দেখায় তার পরিবার। ভি ফর ভিক্টরি! না, যৌক্তিক ভাবে তা সম্ভব নয়। ভেনডেটা? হয়তো। যুদ্ধাপরাধীর রেখে যাওয়া রক্তবীজের ঝাড়েরা হয়তো হুমকি দিয়ে যায় দুই আঙুল তুলে যে লড়াইটা শেষ হয়নি। প্রতিশোধ হবেই। তৈরি আমরা…