আপন সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হবে দেশ

আলী যাকেরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2016, 07:34 PM
Updated : 24 Oct 2016, 07:12 AM

আমার বিশ্বাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। যে সংস্কৃতির কথা বলছি তার অন্তর্ভুক্ত ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিল্পকলা, অর্থনীতি, খাদ্য, সামাজিক আচার, আদবকেতা এবং এমনকি ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাও।

জন্মের পর শিশু চিৎকারের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। আমাদের সংস্কৃতিতে নবজাতকের মুখে মিষ্টি পানি বা মধু দেওয়া হয়। তাকে ‘সোনা, ‘মানিক, ‘জাদু, ‘চাঁদের কণা’ ইত্যাদি বলে ডাকা হয়। করা হয় মুখে ভাতের অনুষ্ঠান বা অন্নপ্রাসন। আমরা যখন ছোট ছিলাম আমাদের মা-বাবারা আমাদের ‘বাবা’ বলে ডাকতেন, এমনকি এখনও ডাকেন। আমরাও আমাদের সন্তানদের ‘বাবা’ বলে ডাকি। অথচ যদি কেবল এই উপমহাদেশের কথাই আমলে নিই, তাহলে দেখব, এখানকার অবাঙালিরা তাদের সন্তানদের ‘বেটা’ বা অন্য কিছু বলে ডাকে। এভাবেই একটি জাতির স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

সুতরাং ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মচর্চার প্যাটার্ন থেকে এ কথা নিশ্চিত যে, আমরা ভিন্ন, স্বতন্ত্র; পাকিস্তানি বা অন্য জাতিগোষ্ঠী চেয়ে আলাদা। আমরা উপলব্ধি করি, জাতি হিসেবে আমরা আলাদা সত্তার অধিকারী। তাই পাকিস্তান আমলে শুধু আমরা নিজেদের পৃথক হিসেবেই চিহ্নিত করি না, একই সঙ্গে বুঝতে পারি আমাদের সবদিক থেকে তারা বঞ্চিত করছে।

তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল, তা শুরু থেকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে। এর মূলে ছিল একটি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রশ্ন।

এই যে জাতিগত চেতনা তা থেকে বিযুক্ত হলে বাংলাদেশ তার সম্পূর্ণতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না।

পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশের প্রথম দিকে এই চেতনাগত প্রশ্নের সামনে ততটা প্রবলভাবে মুখোমুখি হয়নি বাঙালিরা। কিন্তু ক্রমে তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এই স্বাতন্ত্রের প্রতি তাদের দৃষ্টি দিতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে তারা নিজস্ব সংস্কৃতি অন্বেষণে আগ্রহী হয়। তারা নিশ্চিত হয়ে যায়, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে, পাকিস্তান থেকে আলাদা না হলে এ জাতির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়, বাঙালির স্বতন্ত্র পরিচয় ধরে রাখা সম্ভব নয়।

১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসকরা যখন রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ। বাঙালিরা খুঁজে পায় তাদের নিজস্বতা। এই আবিষ্কার তাদের করে তোলে প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল আসলে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ; নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা প্রবাহমান রাখার লড়াই।

তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বিমুখী নীতি, শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন মানুষকে ব্যাপক ক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই ক্ষোভ থেকেই তো বাংলাদেশের মানুষের মনে জাগে মুক্তির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এখানেও কাজ করেছে সেই স্বাতন্ত্রবোধ। তাই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে প্রগতিশীল, অমৌলবাদী, উদারনৈতিক, সংস্কৃতিমনাসহ সব ধরনের শ্রেণি-পেশার মানুষ একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালির আবহমান যে সংস্কৃতি তার অনুপ্রেরণায় মানুষ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।

ফলে স্বাধীনতার পর বাঙালি সংস্কৃতির ধারা স্বাভাবিকভাবেই বেগবান হয়। সংস্কৃতির নানা দিক স্বমহিমায় বিকশিত হতে থাকে।

তবে ইদানিং অনেকেই ‘আকাশ সংস্কৃতি’ তথা ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভি ইত্যাদির প্রকোপে বাঙালি সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে বলে হা-হুতাশ করেন। আমি মনে করি না, দরজা-জানালা বন্ধ রেখে ঘর আলোকিত করা যায়, আর যতটুকুই বা যায় তা-ও কৃত্রিমভাবে। তাই ঘরে আলো-হাওয়া ঢোকার জন্য দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে, শুধু খেয়াল রাখতে হবে-- ধুলাবালি যেন ঢুকে না পড়ে।

আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, আজ যদি এক হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতেন, তাঁর তিন-চারটি নাটক তিন-চারটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার হত, তাহলে কি মানুষ বিদেশি টেলিভিশন দেখত? অবশ্যই না। তার মানে, নিজেদের সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ ও মানসম্মত নাটক-সিনেমা তৈরি করলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নেয় না। এর প্রমাণ সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘আয়নাবাজি’।

এ কারণে আমি চাই, আমি আশা করি, নতুন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক কর্মীরা মার্জিত ও রুচিসম্মত বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা-সম্পৃক্ত পথে এগিয়ে যাবেন। যেসব মূল্যবোধ নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, সেসব মূল্যবোধ অবিকৃতভাবে চর্চিত হবে এই দেশে।

অনুলিখন: হাসান ইমাম